প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে সরিয়ে তাঁর স্কুলশিক্ষিকার চাকরিটি পেয়েছিলেন ববিতা সরকার। এ বার ববিতার পাওয়া সেই চাকরি পেলেন অনামিকা বিশ্বাস রায়। কে এই অনামিকা?
মঙ্গলবার কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়েছে, শুধু ববিতার চাকরিই নয়, প্রাথমিক শিক্ষিকার বেতন বাবদ ববিতা যে টাকা পেয়েছিলেন, সেই ১৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৮৪৩ টাকার পুরোটাই দিয়ে দিতে হবে অনামিকাকে।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি বিতর্কে অনামিকার নাম প্রকাশ্যে আসে গত বছর ডিসেম্বরে। বাংলার মানুষ তাঁকে চিনেছিলেন ববিতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে। সেই ববিতা, যাঁর জন্য খুলে গিয়েছিল বাংলার শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মুখোশ। রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রীর কন্যার চাকরি পাওয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে খবরের শিরোনামে চলে এসেছিলেন যিনি।
অনামিকা ববিতারই শহরের মেয়ে। শিলিগুড়ির দুধমোড় সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা। সরকারি স্কুলের চাকরি না পেয়ে এত দিন একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি করছিলেন তিনি। পাশাপাশি বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
গত ডিসেম্বরে তিনি যে দাবি করেন, তাতে দেখা যায়, সর্ষের মধ্যেই ভূত! শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ‘শুদ্ধকরণে’ নেমে যোগ্য প্রার্থীকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার যে সূচনা করেছিল হাই কোর্ট, তার গোড়াতেই গন্ডগোল।
রাজ্যের হাই কোর্ট নিয়োগ দুর্নীতির ‘শুদ্ধকরণের’ সূচনা করেছিল ববিতাকে চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু অনামিকা দাবি করেন ওই চাকরির আসল দাবিদার ববিতা নন। বরং তিনি।
এসএসসির প্রার্থীর যোগ্যতার নিরিখে ববিতার থেকে র্যাঙ্কিংয়ে এক ধাপ পিছিয়ে ছিলেন অনামিকা। সে জন্যই অঙ্কিতার চাকরি পান ববিতা। কিন্তু ডিসেম্বরে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি এবং বেশ কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। যা ববিতার চাকরি নিয়েও প্রশ্ন তোলে। বলা হয় ববিতার র্যাঙ্কিংয়েই ভুল ছিল।
কী ভুল? গত ২৬ ডিসেম্বর সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিতে তারই উত্তর ছিল। ছবিটি ববিতার আবেদনপত্রের। এসএসসির কাছে ওই আবেদনপত্রটি জমা দিয়েছিলেন ববিতা। তাতে দেখা যাচ্ছে, স্নাতকস্তরে ৮০০ নম্বরের মধ্যে ৪৪০ নম্বর পেয়েছেন ববিতা। অর্থাৎ, শতকরা হিসাবে ৫৫ শতাংশ। অথচ আবেদনপত্রে স্নাতক স্তরের প্রাপ্ত নম্বরের শতকরা হিসাবে লেখা রয়েছে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পাওয়ার কথা।
অনামিকার দাবি করেছিলেন, এই ভুল তথ্য ঠিক করা হলে র্যাঙ্কিংয়ে অন্তত আট ধাপ পিছিয়ে যাবেন ববিতা। আর যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ২০ জনের তালিকার ২০ নম্বরে উঠে আসবে তাঁর নাম। ফলে চাকরিটিও তাঁরই পাওয়ার কথা।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এসএসসির স্কুলশিক্ষিকা পদে এই একটি চাকরিই প্রকাশ্যে এনেছিল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি। যা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন এসএসসি উত্তীর্ণ ববিতা। অনামিকারা তখন টেট পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনে সামিল। কলকাতায় সব সময় যেতে না পারলেও সমর্থন করছেন। আর দেখছেন শিলিগুড়ির ববিতার লড়াই, যিনি নিজের অধিকারের দাবিতে রুখে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রীর মেয়ের বিরুদ্ধে।
ববিতার অভিযোগ ছিল, স্কুলশিক্ষিকার চাকরি পাওয়ার যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ২০ নম্বরের র্যাঙ্কিংয়ে নাম রয়েছে তাঁর। কিন্তু অঙ্কিতার নাম তালিকার অনেক পিছন থেকে এনে এক নম্বরে বসিয়ে দেওয়ায় তিনি যোগ্যদের তালিকা থেকে ছিটকে গিয়েছেন। এই দাবি নিয়েই লড়াইয়ের শুরু যা ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আনে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির জালকে।
২০ মে ববিতার লড়াইয়ের ফল হাতে আসে। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, বেআইনি ভাবে পাওয়া অঙ্কিতার চাকরি দিতে হবে ববিতাকে।
গত ২৭ জুন কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে স্কুলে নিয়োগের সুপারিশপত্র হাতে পান ববিতা। ৩০ জুন পান স্কুলের চাকরির নিয়োগপত্র। মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দেন ৪ জুলাই। ঠিক তার ছ’মাসের মাথায় প্রকাশ্যে আসে ববিতার চাকরিতেও অনিয়মের অভিযোগ।
তত দিনে বেআইনি ভাবে পাওয়া অঙ্কিতার চাকরির বেতনের সমস্ত অর্থ ববিতার হাতে তুলে দিয়েছে আদালত। ১২ অগস্ট সেই অর্থ হাতে পেয়ে ববিতা জানিয়েছিলেন অঙ্কিতার জন্য খারাপ লাগছে। পরে তাঁর চাকরিতেও অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ববিতা জানিয়েছিলেন, তাঁর লড়াই ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাই তাঁর নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি নিজেই আদালতে যাবেন।
এর পরেই হাই কোর্টে মুখোমুখি হন শিলিগুড়ির দুই কন্যা। যদিও অনামিকা জানিয়েছিলেন, ববিতার সঙ্গে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। তিনি শুধু নিজের অধিকারের কথা বলতে চেয়েছেন।
বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা অনামিকা এখন যমজ সন্তানের মা। তাঁর স্বামী শুভজিৎ বিশ্বাস বেসরকারি সংস্থার কর্মী।
হাকিমপাড়া বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর শিলিগুড়ি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্মানিক-সহ স্নাতক হন। পরে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করার পর মাথাভাঙায় বিএড প্রশিক্ষণ নেন অনামিকা।
ববিতার থেকে এক বছরের ছোট অনামিকা জানিয়েছিলেন, ববিতার আবেদনপত্রটির অনিয়মটি ঠিক করা হলে ববিতার অ্যাকাডেমিক স্কোর ৩৩-এর বদলে কমে ৩১ হবে। তাঁর স্কোর চলে আসবে ববিতার আগে।
অন্য দিকে, ববিতা বলেছিলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন তিনি। হয়তো ভুলবশতই স্নাতক স্তরের নম্বরের জায়গাতেও ৬০ শতাংশের ব্র্যাকেটে টিক পড়ে গিয়েছিল তাঁর। ভেরিফিকেশনের সময় পর্ষদ এই ভ্রান্তি লক্ষ্য করলে এই সমস্যা হত না।
তবে ববিতার যুক্তি শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি। শিলিগুড়ির এসএসসি পরীক্ষার্থী অনামিক হাই কোর্টে একটি মামলা করে দাবি করেন, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর কন্যা অঙ্কিতার পাওয়া যে স্কুলশিক্ষিকার চাকরি আদালত ববিতাকে দিয়েছিল, সেটি আদতে তাঁরই প্রাপ্য। আদালত পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে যেন তাঁর প্রতি সুবিচার করে। ববিতার চাকরি বাতিল করে যেন তাঁকে ওই চাকরি দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার সেই আবেদনেরই রায় শোনালেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে ববিতার চাকরি বাতিল করার নির্দেশ দিয়ে বিচারপতি বলেন, ববিতার চাকরি পাবেন অনামিকা রায়। স্কুল সার্ভিস কমিশনকেও বিচারপতি নির্দেশ দেন অনামিকাকে চাকরির সুপারিশপত্র দেওয়ার।