কথায় বলে বিষয় বিষ। কিন্তু হিন্দুজা সহোদরদের গলায় গলায় ভাব দেখে মনে হত এ হেন বিত্তবান পরিবারেও এমনটা সম্ভব! কিন্তু সুখী পরিবারের সেই ছবি আপাতত ভেঙে চুরমার।
একদা একতার তত্ত্বে বিশ্বাসী, ব্যবসায় প্রায় এক থালায় ভাত খাওয়া হিন্দুজা ভাইয়েরা এখন যে যার অন্নের গ্রাস আলাদা করতে ব্যস্ত। তাঁদের বাঁটোয়ারার চেষ্টা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যাপারটা সৌজন্যের সীমা পেরিয়ে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের ভাইয়ে-ভাইয়ে কোন্দলের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এতদিন হিন্দুজা ভাইদের মিলেমিশে থাকার প্রশংসা হত শিল্প মহলে। সেই সুনামে কালি লেপে দেওয়া হয়েছে বলে মত অনেকের।
১০৭ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান। এই মুহূর্তে পৃথিবীর ৪৮টি দেশে ব্যবসা রয়েছে হিন্দুজাদের। কর্মী সংখ্যা দেড় লক্ষেরও বেশি। ১৮০০ কোটি ডলারের বিপুল সম্পত্তির ভাগীদার চার ভাই— শ্রীচাঁদ, গোপীচাঁদ, প্রকাশ এবং অশোক।
হিন্দুজা গ্রুপের চেয়ারম্যান শ্রীচাঁদ। তবে তিনি এখন স্মৃতিভ্রংশ রোগের শিকার। তাঁর ব্যবসা দেখেন দুই মেয়ে এবং একমাত্র দৌহিত্র করম হিন্দুজা। হিন্দুজার বাকি তিন ভাইয়ের ঝগড়া বা অশান্তি এই শ্রীচাঁদের পরিবারের সঙ্গেই।
ভাঙনের সূত্রপাত ২০১৪ সালে। তার কিছুদিন আগেই একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন চার ভাই। চুক্তির বক্তব্য ছিল কোনও এক ভাইয়ের সম্পত্তিতে বাকিদেরও তদারকির অধিকার থাকবে। হিন্দুজাদের মিলেমিশে থাকার ঐতিহ্যে একটা বড়সড় সিলমোহর হতে পারত ওই চুক্তিপত্রটি।
কিন্তু তা হয়নি। পাল্টা ওই চুক্তিই কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় চার ভাইয়ের সম্পর্কে। শ্রীচাঁদ জানিয়ে দেন, ওই চুক্তির কোনও আইনি ভিত্তি নেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সুইৎজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় শুধু তাঁর এবং তাঁর আত্মজদের অধিকার আছে। কিন্তু বাকি তিন ভাই তখনও ব্যবসায় ঐক্যবদ্ধ এবং একক নীতিতে বিশ্বাসী। ফলে ফাটল ধরে হিন্দুজায়। গত কয়েক বছরে যা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে আরও চওড়া হয়েছে।
বিশ্বের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম হিন্দুজা। তিলে তিলে গড়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ১৯১৪ সালে যার পত্তন করেছিল ১৪ বছর বয়সের এক কিশোর।
নাম পরমানন্দ দীপচাঁদ হিন্দুজা। বাড়ি অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের শিখরপুরে। তখন অবশ্য শিখরপুর অবিভক্ত ভারতের অংশ। কিশোর পরমানন্দ ব্যবসা শুরু করবেন বলে মুম্বই (তখন বম্বে) এসেছিলেন।
ভারতের চা, মশলা এবং পোশাক বিদেশে রফতানি করতেন তিনি। বদলে দেশে আমদানি করতেন কেশর, মেওয়া বা শুকনো ফল এবং গালিচা। এ ভাবেই আমদানি-রফতানির ব্যবসায় চারবছরের মধ্যে ইরানে বিদেশে ব্যবসার দফতর খুলে ফেলেন। কালক্রমে সেটাই হয়ে ওঠে হিন্দুজা গোষ্ঠীর সদর দফতর। ততদিনে ইরানের ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রটির অনেকটাই দখল করে বসেছেন হিন্দুজা। ইরানের রাজ পরিবারেরও সঙ্গেও তৈরি হয়েছে ঘনিষ্ঠতা।
তেল ব্যবসায়ী দেশটির অর্থনীতি ততদিনে ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। অথচ খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে। ইরানকে পঞ্জাব থেকে আলু আর পেঁয়াজ জুগিয়ে সাহায্য করেছিলেন পরমানন্দ। সেখান থেকেই রাজ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।
১৯৭১ সালে মৃত্যু হয় পরমানন্দের। হিন্দুজা গ্রুপের ভার এসে পড়ে পরমানন্দের বড় ছেলে শ্রীচাঁদ হিন্দুজার হাতে। তার আট বছরের মাথায় ইরান থেকে উৎখাত হন হিন্দুজারা।
ইরানে তখন ইসলামিক বিপ্লব চলছে। বাধ্য হয়েই ইরান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ইউরোপে চলে আসেন শ্রীচাঁদ। ১৯৮৪ সালে শুরু করেন তেল এবং গ্যাসের ব্যবসা। গাল্ফ অয়েল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড সংস্থাটি কিনে নেয় হিন্দুজারা। তিন বছরের মাথায় গাড়ি শিল্পেও হাত দেয় সংস্থাটি। ব্রিটেনের রোভার গোষ্ঠীর ল্যান্ড রোভার লেল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং সংস্থাটি কিনে নেন হিন্দুজারা। ভারতীয় গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা বজাজের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে হিন্দুজাদের লেল্যান্ড।
ব্যাঙ্কিংয়ের ব্যবসায় হিন্দুজাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। ১৯৯৩ সালে ভারতে হিন্দুজারা তৈরি করে ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্ক। ১৯৯৫-এ কেবল টিভির ব্যবসা শুরু করতে ইন্ডাসইন্ড মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুজা শিল্প গোষ্ঠী।
এখন হিন্দুজা বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম । গাড়িশিল্প, তেল, রাসায়নিক, ব্যাঙ্কিং, তথ্য ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, জমি বাড়ির ব্যবসা, বিদ্যুৎ-সহ ১১টি ক্ষেত্রে ব্যবসা রয়েছে হিন্দুজাদের।
লন্ডনে বাকিংহাম প্যালেসের কাছেই হিন্দুজাদের প্রাসাদোপম বসতবাড়ি। বছর কয়েক আগেই সেখানে একটি রাজকীয় নৈশভোজের টেবিল সংস্কার করেছিলেন হিন্দুজারা। ৩২ জনের বসার ব্যবস্থা। পরিবারের সবাই একসঙ্গে মিলিত হলে একসঙ্গে বসে আনন্দ করে খাওয়া যাবে এমনই পরিকল্পনা থেকে।
পুরনো প্রবাদ বলে, ফ্যামিলি দ্যাট ইটস টুগেদার স্টে টুগেদার। অর্থাৎ যে পরিবার একসঙ্গে খায় একসঙ্গে থাকেও। নৈশাহারের ৩২ আসনের সেই টেবিল এখনও আছে। তবে সেখানে বসে হয়তো আর একসঙ্গে খাওয়া হবে না হিন্দুজাদের।