তিনি শেরপা। তবে পর্বতারোহীদের নিয়ে পাহাড়ে চড়েন না। কিন্তু নয়াদিল্লির জি২০ শীর্ষ বৈঠকে দেশের বার্তাবাহক তিনিই। এক কথায় বলতে গেলে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের তিনিই সারথি।
কথা হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস আধিকারিক অমিতাভ কান্তকে নিয়ে। টালমাটাল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘ঐক্যের সুর’ বাঁধতে একের পর এক বৈঠক করে চলেছেন তিনি। তবে প্রচারের আলো থেকে রয়েছেন শতহস্ত দূরে।
জি৭ কিংবা জি২০-র মতো আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলিকে সফল করার নেপথ্যে বড় ধরনের ভূমিকা রাখেন শেরপারা। পথ দেখিয়ে যাঁরা পর্বতারোহীদের পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছে দেন, তাঁদেরই শেরপা বলা হয়।
আর এই ধরনের বৈঠকে অমিতাভের মতো শেরপাদের কাজ আন্তর্জাতিক নানা সমস্যার সমাধানে সদস্য দেশগুলির মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার।
পর্বতের চড়াই-উতরাইয়ের মতোই নানা তর্ক-বিতর্ক, মতান্তর পেরিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছনোর কাজ করতে হয় বলেই পদটির নাম শেরপা বলে মনে করা হয়। শেরপা হলেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের দূত।
এই সূত্র মেনেই জি২০ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দূত হলেন অমিতাভ। এই শীর্ষ বৈঠকে ভারত যে অবস্থান নিতে চলেছে, তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাবে অমিতাভের কাজে। সদস্য দেশগুলির শেরপাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝাপড়ায় আসার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন তিনি।
বৈঠকের শেষে দস্তুরমতো যৌথ ঘোষণাপত্র পেশ করবে জি২০ সদস্য রাষ্ট্রগুলি। কিন্তু সেই ঘোষণাপত্রে যেন ঐক্যের সুরটি কেটে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয় আয়োজক দেশকে। কারণ তার উপরেই বৈঠকের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম জি২০ বৈঠক হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর। যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকার প্রভাবাধীন পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে রাশিয়া এবং চিনের মতানৈক্যের বিষয়টি তখনই প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল। তবে তার মধ্যেই মোটের উপর একটা ‘বোঝাপড়া’ ধরা পড়েছিল বালির যৌথ ঘোষণাপত্রে।
এ বার পরিস্থিতি আরও জটিল বলে মনে করছেন অনেকে। জলবায়ু সঙ্কট, রুশ-ইউক্রেন সংঘাত কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ে আমেরিকা এবং রাশিয়াকে আলোচনার এক টেবিলে বসানো যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অমিতাভের ভূমিকা।
১৯৮০ সালের কেরল ব্যাচের আইএএস আধিকারিক অমিতাভ প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘আস্থাভাজন’ বলেই পরিচিত। ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মতো একাধিক সরকারি প্রকল্পের নেপথ্যে তাঁরই মাথা ছিল।
ক্ষমতায় আসার পরই ২০১৫ সালে পুরনো যোজনা কমিশন ভেঙে নীতি আয়োগ তৈরি করেছিল মোদী সরকার। নীতি আয়োগের প্রথম মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক (সিইও) হিসাবে অমিতাভকে নিযুক্ত করে সরকার।
কোভিড-১৯ অতিমারির মোকাবিলায় উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে কেন্দ্র যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গড়েছিল, তাঁরও নেতৃত্বে ছিলেন অমিতাভ। কেরল পর্যটনের প্রখ্যাত বিজ্ঞাপন, ‘কেরল: ঈশ্বরের আপন দেশ’-এর ধারণাও অমিতাভের মস্তিষ্কপ্রসূত।
অমিতাভ অর্থনীতির ছাত্র। জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় প্রাক্তন আমলা, অধুনা বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের। তাঁর মতো ‘মধ্যমেধার মানুষ’কে অনুপ্রাণিত করার কৃতিত্ব ‘মেধাবী’ জয়শঙ্করকেই দিয়েছেন অমিতাভ।
ঘটনাচক্রে, ২০২২ সালের জুন মাসে শেরপা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন অমিতাভ। এ ক্ষেত্রে জয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পুরনো রসায়ন কাজে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের শেরপা।
ইতিমধ্যেই সদস্য দেশগুলির শেরপাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে যৌথ ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছেন অমিতাভ। জানিয়েছেন যে, এই ঘোষণাপত্রে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলির কন্ঠস্বর শোনা যাবে। তবে এর অতিরিক্ত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
আগামী রবিবার জি২০ শীর্ষ বৈঠকের শেষে ঘোষিত হবে দিল্লি ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণায় ঐক্যের সুর কতটা শোনা যাবে, তা নিয়ে সংশয় অনেকেরই। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অমিতাভও।
গত বছর বালির যৌথ ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত হয়েছিল মোদীর সেই মন্তব্য— “এটা যুদ্ধের সময় নয়।” ওই ঘোষণাপত্র তৈরিতেও অমিতাভ বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল। তাঁর পরীক্ষা হবে দেশের মাটিতে।
নয়াদিল্লির কর্মজীবনে বহু বার কর্মস্থল বদলেছে অমিতাভের। প্রথমে সম্রাট হোটেল, তার পর উদ্যোগ ভবন, তারও পরে নীতি আয়োগ ভবন এবং এখন সুষমা স্বরাজ ভবন। শেষোক্ত এই ভবনেই জি২০ বৈঠক সংক্রান্ত কাজ চলেছে।
অমিতাভের ঘনিষ্ঠজনেরা জানাচ্ছেন, অফিস বদলেছে, বদলেছে দায়িত্বও। তবে মানুষ অমিতাভের নাকি কোনও বদল হয়নি। প্রবল চাপের মুখেও নাকি নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আর অবসরে শুনছেন প্রিয় গজ়ল।