এক মহাকাশ বিশেষজ্ঞ মজা করে বলেছেন, ‘‘রাতের আকাশ যদি তারাখসা দেখেন, তবে সেটি উল্কাপাত হতে পারে, আবার অন্য কিছুও হতে পারে।’’ কী সেই ‘অন্য কিছু’? তার উত্তর মিলবে এই প্রতিবেদনের শেষে। তার আগে বরং একটি গল্প বলা যাক।
মহাকাশে গিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসা। এটুকুই কাজ ছিল। লঞ্চপ্যাডে মহাকাশযানের ভিতর অপেক্ষা করছিলেন মহাকাশচারীও। নানা কারণে উৎক্ষেপণে দেরি হচ্ছিল। প্রায় দু’ঘণ্টা পেরিয়ে যেতে হঠাৎ শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল মহাকাশচারীর। অথচ মহাকাশযানে কোনও শৌচালয় নেই!
যে কোনও মুহূর্তে উড়তে পারে রকেট। প্রয়োজনের কথা জানাতেই এল কড়া নির্দেশ। চেপে বসে থাকো। ১৫ মিনিটের ব্যাপার। একটু পরেই রকেট উড়বে...।
মহাকাশচারীর গায়ে তখন স্পেসস্যুট। সেই পোশাক ছেড়ে মহাকাশযান ছেড়ে বেরিয়ে লঞ্চ প্যাডে নামা, তার পর সেখান থেকে মাইলখানেক দূরে শৌচাগারে যেতেই আধ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যাবে! ফিরতেও সময় লাগবে ততটাই। ‘সামান্য’ কাজের জন্য দেশের মহাকাশ অভিযানের সময় এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেবেন, এমন মানুষ নন মহাকাশচারী অ্যালান শেপার্ড। ‘অর্ডার’ শুনে তাই তিনিও ‘চেপে বসে থাকা’রই সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিন্তু ‘সামান্য’ কাজটি যে মোটেই সামান্য নয়, তা বুঝলেন মিনিট দশ পেরোনোর পরই। তখনও মহাকাশযান রওনা হয়নি। তখনও চলছে প্রস্তুতি। অ্যালান বুঝলেন আগামী ১৫ মিনিটের একটি মুহূর্তও তিনি কোনও কাজে মন দিতে পারবেন না, যদি এই মুহূর্তে ভারমুক্ত না হন।
১৯৬১ সালের ঘটনা। ওই বছরই মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠিয়েছিল নাসা। অ্যালান ছিলেন বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী। ঐতিহাসিক মুহূর্তের আগে নাসার হয়ে তাঁর প্রথম মহাকাশ ভ্রমণের আগেই ঘটে এই ঘটনা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল।
সে দিন লঞ্চপ্যাডে মহাকাশযানের ভিতর অপেক্ষা করতে করতেই নিজের প্যান্ট ভেজাতে বাধ্য হয়েছিলেন অ্যালান। চিরতরে সিক্ত হয়েছিল মানুষের মহাকাশ ছোঁয়ার ইতিহাস। তবে ওই ঘটনার পরই নাসার টনক নড়ে।
মহাকাশযানে মহাকাশচারীদের জন্য শৌচালয় রাখা কতটা জরুরি, তা বুঝতে পারেন বিজ্ঞানীরা। শুরু হয় শৌচালয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা। হাজার হোক বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া যতটা জরুরি, শরীরে জমে থাকা ক্লেদ বিসর্জনের ওই কাজ দু’টিও তো ততটাই জরুরি!
সেই নাসাই সম্প্রতি ২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ১৯০ কোটি ১১ লক্ষ টাকা ব্যয় করে শৌচাগার বানিয়েছে মহাকাশচারীদের জন্য। কী কী আধুনিক ব্যবস্থা আছে তাতে?
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ওই শৌচাগারের ব্যাপারে জানার আগে জেনে নেওয়া দরকার, এর আগে এ নিয়ে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন মহাকাশচারী বা মহাকাশ অভিযাত্রীরা।
অ্যালানের ঘটনাটি ঘটেছিল ষাটের দশকের শুরুতে। নাসার তথ্য বলছে সত্তরের দশক শুরুর মুখেও মহাকাশযানে শৌচের সমস্যা নিয়ে অভিযোগ এসেছিল নাসার কাছে। অভিযোগ করেছিলেন দুই চন্দ্রাভিযাত্রী নিল আর্মস্ট্রং এবং ‘বাজ’ এডউইন অলড্রিন।
নাসার তথ্য অনুযায়ী অ্যাপোলো ১১ চন্দ্রাভিযানে ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি চাঁদে পদার্পণ করেছিলেন নিল এবং বাজ। তাঁদের শৌচের জন্য পিছনে আঠা দিয়ে সেঁটে নিতে হত বর্জ্য সংগ্রহের ব্যাগ।
আর মূত্র সংগ্রহের জন্য ছিল এক ধরনের যন্ত্র। যা আসলে একটি পাইপের মুখে আটকানো কন্ডোম বা নিরোধের মতো দেখতে প্যাকেট। জরুরি কাজ শেষ হলে স্রেফ একটি নব ঘোরালেই সংগৃহীত তরল পৌঁছে যেত মহাশূন্যে।
পরবর্তী কালে আরও অ্যাপোলো অভিযান হয়েছে। ধীরে ধীরে বদলেছে মহাকাশচারীদের বর্জ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া। যদিও অ্যাপোলোর মহাকাশচারীরা তাদের এই সমস্যার কথা বার বার জানিয়ে এসেছেন নাসাকে।
দীর্ঘ দিন মহাকাশচারীদের পিছনে ব্যাগ আটকানোর এই পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু এই ব্যাগগুলি কোথায় যেত? এই সব ব্যাগ কি নিয়ে ফিরে আসতেন মহাকাশচারীরা? না কি মহাশূন্যে ফেলে আসতেন?
নাসা জানাচ্ছে, প্রত্যেকটি এই ধরনের ব্যাগের সঙ্গে থাকত আঙুলের ঢাকনা। জরুরি কাজ শেষ হলে হাতে আঙুলের ঢাকনা গলিয়ে ব্যাগ খুলে নিজের বর্জ্যের সঙ্গে জীবাণুনাশক মেশাতে হত মহাকাশচারীদের। যাতে মুখ বন্ধ ব্যাগে ব্যাকটেরিয়া থেকে গ্যাস না তৈরি হয়। কারণ তা হলে ব্যাগ ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে।
এই পদ্ধতিই চালু ছিল দীর্ঘ দিন। পরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরি হওয়ার পর শৌচাগার তৈরিতে মন দেয় নাসা। তৈরি হয় মহাকাশযানে ব্যবহারের বিশেষ ধরনের শৌচাগার। যাতে থাকবে বর্জ্য টেনে নেওয়া জোরালো ক্ষমতা। তার পর দ্রুত তাকে ব্যাগবন্দি করে সরিয়ে ফেলার ক্ষমতাও।
মহাকাশ স্টেশনে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না। ফলে তরল বা কঠিন যে কোনও বস্তু আলগা থাকলেই তা ছিটকে যেতে পারে যে কোনও প্রান্তে। তাই টয়লেটে বসার সময় মহাকাশচারীদের বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখতে হত নিজেকে। তবে এই পদ্ধতি আরও উন্নত হয় ২০১৮ সালের পর।
পৃথিবীর মাটিতে যেমন ছোটখাটো ‘পাবলিক টয়লেট’ থাকে এখন মহাকাশ স্টেশনেও রয়েছে তেমনই চারপাশ ঘেরা দরজা বন্ধ করার সুবিধা সম্পন্ন টয়লেট। এই টয়লেটগুলোই ১৯০ কোটি ১১ লক্ষ টাকার সমান অর্থ ব্যয় করে বানিয়েছে নাসা।
ভিতরে রয়েছে একটি ভ্যাকুয়াম টয়লেট। যার আকার লম্বাটে সিলিন্ডারের মতো। পরিধি অনেকটা সাধারণ মাপের থালার আকৃতির।
এই শৌচ যন্ত্রে দু’টি অংশ থাকে। একটি অংশে থাকে পাইপের সঙ্গে জোড়া ফানেল। বাকিটা একটি স্টিলের টানেলের মতো ঢাকনা দেওয়া অংশ। এর উপরেই হাতে, পায়ে এবং শরীরে বেল্ট বেঁধে বসতে হয় মহাকাশচারীদের। যাতে কোনও ভাবেই টানেলের মতো অংশটির কোনও অংশ ফাঁকা না থাকে।
স্টিলের টানেলটির ঢাকনা খুললেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে শুরু হয়ে যায় সাকশন প্রসেস অর্থাৎ যে কোনও বস্তুকে টেনে নেওয়ার প্রক্রিয়া। যাতে শূন্য মাধ্যাকর্ষণের জন্য কোনও দূষিত বস্তু কোনও ভাবেই ভিতরে ভেসে না বেড়ায় এবং যাতে কোনও দুর্গন্ধ বাইরে এসে মহাকাশ স্টেশনের আবহাওয়াকে দূষিত না করে।
প্রস্রাবের জন্য অবশ্য থাকে আলাদা ব্যবস্থা। মহাকাশচারীদের প্রস্রাবকে শুদ্ধ করে আবার মহাকাশযানে বা মহাকাশ স্টেশনে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। মহাকাশচারীরা ব্যাপারটিকে মজা করে বলেন, ‘‘আজকের কফি আসলে কালকের কফি।’’ কিন্তু কঠিন বর্জ্যগুলির কী হয়?
নাসা জানাচ্ছে, এই বর্জ্যগুলিকে ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করে ব্যাগে ভরে রেখে দেওয়া হয় মজুতের জায়গায়। পরে তা ফিরিয়ে আনা হয় পৃথিবীতে। মহাকাশ স্টেশনের ক্ষেত্রে পৃথিবী থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসে রাশিয়ার তৈরি প্রোগ্রেস স্পেসক্র্যাফট। তাতেই তুলে দেওয়া হয় ওই সমস্ত ব্যাগ।
কিন্তু পৃথিবীতে এনে কী করা হয় ওই ব্যাগগুলি? নাসা বলছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তবে আগুন লাগিয়ে নয়। পৃথিবীর আবহাওয়া মণ্ডলে প্রবেশ করার মুহূর্তে মহাকাশযান থেকে ফেলে দেওয়া হয় সেগুলি। আবহাওয়া মণ্ডলের ঘর্ষণেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় ব্যাগগুলি।
এক মহাকাশ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গেই মজা করে বলেছেন, ‘‘রাতের আকাশ যদি তারাখসা দেখেন, তবে সেটি উল্কাপাত হতে পারে। আবার মহাকাশচারীদের জ্বলন্ত বিষ্ঠাও হতে পারে’’!