রুপোলি দুনিয়ার অন্ধকার জগৎ! সেই চোরাগলিতে ঢুকে পথ হারাচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা। শুধু তা-ই নয়, অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। কিন্তু কেন? কী ভাবেই বা নিষ্ঠুর নিয়তির হাত থেকে মিলবে পরিত্রাণ? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নাকের জলে চোখে জলে হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র।
বর্তমানে জটিল সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন জগৎ। প্রায়ই রহস্যজনক ভাবে মিলছে সেখানকার পপ তারকা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেহ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা আত্মঘাতী হয়েছেন বলে মনে করছে পুলিশ। যদিও তার কারণ বুঝতে পারছেন না তদন্তকারীরা।
উদাহরণ হিসাবে বছর ২৪-এর অভিনেত্রী কিম সে-রনের কথা বলা যেতে পারে। রাজধানী সোলের বাসভূমি থেকে তাঁকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় প্রশাসন। ‘ব্লাডহাউন্ডস’-এ অসাধারণ অভিনয়ের জন্য জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন তিনি। কিম আত্মঘাতী হয়েছেন বলে জানিয়েছে সোল পুলিশ।
‘ব্লাডহাউন্ডস’-এর তারকা অভিনেত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। গত কয়েক বছরে একই সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গিয়েছে আরও কয়েক জন রুপোলি ও বিনোদন জগতের কোরীয় তারকাকে। আর তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে নড়চড়ে বসেছেন সোলের কর্তাব্যক্তিরা।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রগুলির মধ্যে কোরীয় সংস্কৃতির আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। ঝাঁ-চকচকে উজ্জ্বল নান্দনিকতা দেখে এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন তরুণ-তরুণীদের একাংশ। কিন্তু বিশ্লেষকদের কথায়, দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন জগৎ শুধুমাত্র মিঠেকড়া রোদ আর রামধনু দিয়ে সাজানো নয়। এর একটা অন্ধকার দিক রয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হল বিনোদন সংস্থাগুলির সঙ্গে তাঁদের চুক্তি। অর্থের আকাঙ্ক্ষায় ওই কোম্পানিগুলির জন্য দিনের পর দিন এক রকম ‘দাসত্ব’ করেন তাঁরা। একটা সময়ের পর যখন সেটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, তখনই অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
এ ব্যাপারে উদীয়মান পপশিল্পীদের কথা বলা যেতে পারে। বিনোদন সংস্থাগুলির কাছে তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রার্থী ছাড়া অন্য কিছু নন। মাত্র ১২ বছর বয়সে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে তাঁদের যোগদান করতে হয়। এর পর পপশিল্পী হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় ওই সংস্থার উপর।
বিষয়টি শুনতে আকর্ষণীয় মনে হলেও বাস্তবে তা একেবারেই নয়। কারণ বিনোদন সংস্থায় যোগ দেওয়া উদীয়মান পপশিল্পীদের নিজস্ব জীবন বলে কিছু থাকে না। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাঁদের খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে আচার-আচরণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। চুক্তি করা সংস্থাকে না জানিয়ে নিজের ভালবাসার মানুষটিকেও বেছে নিতে পারেন না কোরীয় পপশিল্পীরা।
দক্ষিণ কোরিয়ার পপশিল্পীরা যে এর বিরুদ্ধে কখনও কোনও প্রতিবাদ করেননি, এমনটা নয়। ‘দাস চুক্তি’র বিরুদ্ধে মামলা করে আইনি লড়াইয়ে জড়িয়েছেন তারকাদের একাংশ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ক্রিস এবং লুহান। ‘এসএম এন্টারটেনমেন্ট’ নামের বিনোদন সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার এবং বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা।
গত বছর মহিলা ব্যান্ড ‘নিউজিন্স’ বিনোদন সংস্থা ‘অ্যাডর’-এর চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। কোম্পানির বিরুদ্ধে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’-এর অভিযোগ এনেছিলেন ওই পপ তারকারা। এতে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এ ক্ষেত্রে পপ তারকাদের কথা শুনে শুধুমাত্র বিনোদন সংস্থাগুলিকে দায়ী করা ঠিক হবে না। পপশিল্পীদের একাংশের বিরুদ্ধেও বার বার অসামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে বহু বিনোদন সংস্থা।
তবে এটা ঠিক যে, পপ তারকারা নিষিদ্ধ বই পড়া এবং প্রেমিক বা প্রেমিকা থাকার কারণে বহু বার বিপদে পড়েছেন। বিনোদন সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে এই ধরনের তারকাদের কালো তালিকাভুক্ত করার ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন ‘রেড ভেলভেট’-এর জনপ্রিয় পপ তারকা আইরিন। তিনি জানিয়েছেন, একবার ‘কিম জ়ি-ইয়ং, জন্ম ১৯৮২’ নামের একটি নারীবাদী বই পড়ার জন্য শো বাতিল হয়েছিল তাঁর। ভক্তদের কেউ কেউ আইরিনের ছবি পর্যন্ত পুড়িয়েছিলেন।
পপ দল ‘এফ (এক্স)-এর সাবেক সদস্য সুলির পরিণতি হয়েছিল আরও খারাপ। নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতেন তিনি। ফলে সমাজমাধ্যমে ট্রোলিংয়ের শিকার হন সুলি। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে মাত্র ২৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার ওই পপ তারকা ও অভিনেত্রী।
প্রায় একই রকমের ঘটনা ঘটে ‘শাইনি’ ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী বছর ২৭-এর কিম জং-হিউনের সঙ্গে। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে অচৈতন্য অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা কিমকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
কিমের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে লম্বা সময় ধরে তদন্ত চালিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশ। শেষে রিপোর্টে তদন্তকারীরা জানান, মারাত্মক মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন ওই পপ তারকা। তিনিও ছিলেন ট্রোলিংয়ের শিকার। অবসাদ কাটাতে ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করেন। শেষে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটির সংবাদ সংস্থাগুলির দাবি, দিন দিন সেখানে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাড়ছে ট্রোলিংয়ের প্রবণতা। মূলত বিনোদন জগতের তারকাদেরই নিশানা করেন তাঁরা। ট্রোলিংয়ের ক্ষেত্রে শালীনতার সীমা অনেকে অতিক্রম করছেন বলেও জানা গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সমাজমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশাসন। আগামী দিনে এই নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি করতে পারে সোল। যদিও সরকারি ভাবে তা নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।