তাঁর ছিল অঢেল সম্পত্তি। সেই সময় বিশ্বের এক নম্বর ধনী ব্যক্তি বলা হত তাঁকে। সেই তিনিই কিনা অপহরণকারীদের কবল থেকে নাতিকে উদ্ধারের জন্য মুক্তিপণ দিতে এক টাকা খরচ করতেও রাজি হননি। এমনকি, মুক্তিপণের পরিমাণ নিয়ে দর কষাকষি পর্যন্ত করেছেন। বিশ্বের সেই বিত্তবানের আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তা হল, তিনি বড্ড কৃপণ। ধনকুবের জ়্য পল গেটির কিপটেমির কাহিনি বেশ চর্চিত।
১৮৯২ সালে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে জন্ম গেটির। ১৯৪২ সালে ‘গেটি অয়েল কোম্পানি’ তৈরি করেছিলেন তিনি। বিশ্ব জুড়ে তেলের বিশাল ব্যবসা ছিল তাঁর। আর সেই সুবাদেই তাঁর এত সম্পত্তির বহর। সত্তরের দশকে গেটির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার।
ধনকুবের হিসাবে গেটি যত না চর্চিত ছিলেন, তার থেকে বেশি পরিচিত ছিলেন কিপটেমির জন্য। টাকা খরচের ব্যাপারে ভীষণই হিসাবি ছিলেন গেটি। টাকা খরচের বিষয়ে তিনি যে কতটা সাবধানী, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল সত্তরের দশকে। গেটির আচরণে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন সকলে।
মহিলাদের প্রতি বিশেষ আসক্তি ছিল গেটির। তাঁর ৫ জন স্ত্রী ছিলেন। তবে কারও সঙ্গেই বিয়ে টেকেনি এই ধনকুবেরের। তৃতীয় সন্তান জন পল গেটি জুনিয়রের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না গেটির।
জন পল গেটি জুনিয়রের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় পুত্র তৃতীয় জন পল গেটি। ১৯৭৩ সালে গেটির ওই নাতিকে রোমে অপহরণ করা হয়েছিল। যা বিশ্বের অন্যতম চর্চিত ঘটনা।
মিনিয়াপোলিসে জন্ম হলেও পলের শৈশব কেটেছে রোমে। কারণ পারিবারিক ব্যবসার কারণে রোমে যেতে হয়েছিল তাঁর বাবা জন পল গেটি জুনিয়রকে। সেই রোম থেকেই তাঁকে অপহরণ করা হয়।
১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই। সে দিন রাত ৩টে নাগাদ রোমের পিয়াজ়া ফারনেসিতে বাড়ির কাছে ঘুরছিলেন তৃতীয় জন পল গেটি। সেখানে আগামী দিনের সংবাদপত্র এবং মিকি মাউসের বই কিনতে বেরিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৬।
সেই সময়ই একটি গাড়িতে করে ৩ যুবক এসে পলকে পিস্তল দেখিয়ে অপহরণ করেন। এই ঘটনার পরের দিন পলের মা একটি ফোন পান। ফোনে ১ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার মুক্তিপণ চান অপহরণকারীরা।
পল নিখোঁজ হওয়ার পর তদন্ত শুরু করেছিল পুলিশ। দাদুর কাছ থেকে টাকা হাতাতে পল নিজেই অপহরণের ছক কষেছেন— তাঁর মাকে এমনটাই জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। পুলিশ আরও জানিয়েছিল, বন্ধুদের সঙ্গে অপহরণের নাটক করার পরিকল্পনাও করেছিলেন পল। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয়নি। পরে তাঁর মা অ্যাবিগেইল হ্যারিসও বুঝতে পারেন এ কথা।
অপহরণকারীদের খপ্পর থেকে পুত্রকে উদ্ধার করতে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করেন পলের মা। কিন্তু নাতির জীবন বাঁচাতে মুক্তিপণের টাকা দিতে রাজিই হননি গেটি। জঁ পলকে মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তাঁর পুত্র গেটি জুনিয়র। কিন্তু তা দিতে অস্বীকার করেন তিনি।
নাতির অপহরণ প্রসঙ্গে সেই সময় সংবাদমাধ্যমে গেটি বলেছিলেন, ‘‘অপহরণকারীদের টাকা দেওয়ার পক্ষপাতী নই। আমার আরও ১৪ জন নাতি রয়েছে। আমি যদি ১ পয়সাও দিই, তা হলে আমার আরও ১৩ জন নাতি অপহৃত হবে।’’
অর্থাৎ গেটির আশঙ্কা ছিল যে, তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতাতে অন্য নাতিদেরও অপহরণ করা হতে পারে। এই ভাবে অপহরণকারীরা যাতে তাঁকে নিশানা করতে না পারেন, সেই কারণে পলের অপহরণের পরও মুক্তিপণের জন্য টাকা খরচ করতে রাজি হননি গেটি।
এই ভাবে ৫০ দিন পার হয়ে যায়। কিছুতেই গেটি পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে না পেরে অস্থির হয়ে পড়েন অপহরণকারীরা। ভয় দেখাতে এর পর অক্টোবর মাসে পলের চুল কাটেন অপহরণকারীরা। এর পরে তাঁর ডান কানও কেটে ফেলা হয়।
পলের চুল এবং ডান কান ব্যাগে করে রোমের সংবাদপত্র ‘ইল মেসাজ়েরো’-এর দফতরে পাঠান অপহরণকারী। ব্যাগের সঙ্গে একটি চিঠিও পাঠান তাঁরা। তাতে লেখা ছিল, ১০ দিনের মধ্যে যদি মুক্তিপণ না দেওয়া হয়, তা হলে আরও একটি কান পাঠানো হবে। তত দিনে অবশ্য মুক্তিপণের অঙ্কটাও কমান অপহরণকারীরা। ১ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার থেকে কমিয়ে অপহরণকারীরা ৩০ লক্ষ ডলার মুক্তিপণ দাবি করেন।
সংবাদপত্রের তরফে খবর দেওয়া হয় গেটি পরিবারে। পারিবারিক আইনজীবী সংবাদপত্রের দফতর থেকে সেই ব্যাগটি সংগ্রহ করেন। পুত্রের কানে বিশেষ দাগ ছিল, তা দেখেই পলের মা বুঝতে পারেন যে, কানটি তাঁর পুত্রেরই।
এর পরই নড়েচড়ে বসে গেটি পরিবার। নাতির কাটা কান দেখে তৎপর হন গেটিও। মুক্তিপণের পরিমাণ কমানোয় শেষমেশ অপহরণকারীদের টাকা মেটাতে রাজি হন গেটি। তবে সাফ জানিয়ে দেন যে, ২২ লক্ষ ডলারের বেশি অর্থ দেবেন না। বাকি ৮ লক্ষ ডলার ৪ শতাংশ সুদে পুত্রকে ধার দেন।
মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার পরই তৃতীয় জন পলকে মুক্তি দেন অপহরণকারীরা। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইটালির লরিয়া থেকে তাঁকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পর মায়ের কথামতো দাদুকে ফোন করেছিলেন তিনি। কিন্তু নাতির ফোন ধরেননি দাদু। পরে এক ব্যক্তির মাধ্যমে নাতিকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান গেটি।
অপহরণের ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র ২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। বাকিরা প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যান। পলের যে কানটি অপহরণকারীরা কেটেছিলেন, ১৯৭৭ সালে সেটির অস্ত্রোপচার করা হয়।
১৯৭৩ সালে চিত্রগ্রাহক মার্টিন জাকেরের সঙ্গে বিয়ে হয় পলের। বয়সে বড় এবং ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মার্টিনকে পছন্দ করেননি গেটি। পল এবং মার্টিনির পুত্রসন্তান হয়। তাঁর নাম বালথাজ়ার গেটি। যিনি আমেরিকার এক জন সফল অভিনেতা। ১৯৮১ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন পল। যার জেরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০১১ সালে ৫৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
পলের অপহরণের ঘটনা এবং মুক্তিপণ দেওয়া নিয়ে তাঁর ধনকুবের দাদু গেটির টালবাহানা— এই নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছে। ২০১৭ সালে এই কাহিনি নিয়েই তৈরি হয় ‘অল দ্য মানি ইন দ্য ওয়র্ল্ড’ সিনেমা।