মন শান্ত করার জন্য শহরের কোলাহল এড়াতে অনেকেই প্রত্যন্ত জায়গায় হোটেল বা হোমস্টের সন্ধান করেন। সেখানে নিরিবিলিতে সময় কাটিয়ে আবার ফুরফুরে মন নিয়ে দৈনন্দিন জীবন শুরু করেন নতুন উদ্যম নিয়ে। কিন্তু হোটেলে থাকার সময় যদি আপনার সঙ্গে ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব কাণ্ড? সারা শরীরে হঠাৎ ফুটে ওঠে আঁচড়ের দাগ? ঘর ভরে যায় আঁশটে গন্ধে? বাস্তবে এমনই ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন এক বিলাসবহুল হোটেলের অতিথিরা।
বিলাসবহুল আয়োজনের জন্য তো বটেই, রোগ নিরাময়ের জায়গা হিসাবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বেকার হোটেল অ্যান্ড স্পা। হোটেলের মালিক টিডি বেকারের নামে হোটেলটির নাম রাখা হয়।
লোকের মুখে মুখে প্রচার শুরু হওয়ার পাশাপাশি বেকার হোটেলকে ঘিরে ক্রমে জট পাকতে থাকে রহস্য। হঠাৎ হোটেলে ভিড় জমে ওঠে মানসিক রোগীদের। ‘অশরীরী’দের উপস্থিতিও নাকি টের পেতে শুরু করেন হোটেলের অতিথিরা।
টেক্সাসের মিনারেল ওয়েলসের ৮২ কিলোমিটার পশ্চিম প্রান্তে নির্জন জায়গায় ১৯২৬ সাল থেকে শুরু হয় হোটেল নির্মাণের কাজ। তিন বছর কাজ চলার পর বেকার হোটেল অ্যান্ড স্পা তৈরির কাজ শেষ হয়।
একাধিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, হোটেল তৈরি করতে সেই আমলেই প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। ১৯২৯ সালে হোটেলটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। হোটেলের অন্দরসজ্জা দেখে সকলের তাক লেগে যায়।
স্পা, সুইমিং পুল থেকে শুরু করে ১৪ তলার হোটেলে ছিল মোট ৪৫০টি ঘর। সেই ঘরগুলিও ছিল দেখার মতো। হোটেলে যে জল ব্যবহৃত হত তা নাকি ছিল গুণসমৃদ্ধ। অতিথিদের মুখে সেখানকার জলের প্রশংসাও ঘোরাফেরা করতে শুরু করে।
অতিথিরা বলতে শুরু করেন, হোটেলের জল খেলে নাকি শরীরে বল ফিরে পান তাঁরা। জলের টানেই সেখানে ধীরে ধীরে ভিড় জমাতে শুরু করেন বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দারা। কিন্তু কয়েক বছর পরই ব্যবসা ডুবে যেতে থাকে।
১৯৩২ সালে হোটেলের মালিক সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যান। শেয়ার বাজারের পতনের কারণে অর্থাভাবে ডুবে যান তিনি। তার পর থেকে শুরু হয় মালিকানায় বদল। একের পর এক মালিকের হাতবদল হতে থাকে হোটেলটি। তারই মাঝে হঠাৎ হোটেলটিকে ঘিরে ছড়ায় গুজব।
কানাঘুষো শোনা যায়, হোটেলের এক অতিথি নাকি বহু দিন মানসিক রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু হোটেলে গিয়ে কিছু দিন কাটানোর পর সেখানকার জল পান করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। হোটেলের জলেই নাকি আশ্চর্য গুণ।
রোগ নিরাময়ের খবর পাঁচকান হতেই হোটেলে ভিড় জমাতে থাকেন দলে দলে মানসিক রোগী। কারও স্মৃতিলোপ হয়েছে তো কেউ আবার মানসিক অবসাদগ্রস্ত। সকলের ধারণা ছিল হোটেলের জলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁদের ‘মহৌষধ’।
মানসিক রোগীদের পাশাপাশি হোটেলে থাকতেন অন্য অতিথিরাও। তবে এক দিকে যেমন জলের জন্য হোটেলটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, অন্য দিকে হোটেলটির গায়ে ‘ভূতুড়ে’ তকমা লেগে যায়। অতিথিরা বলতে শুরু করেন যে, এই হোটেলে নাকি প্রেতাত্মার উপস্থিতি রয়েছে।
অতিথিদের অভিযোগ, মাঝেমধ্যেই তাঁরা অনুভব করতেন পিছন থেকে কেউ ধাক্কা মারছে। অথচ আশপাশে কাউকে দেখতে পেতেন না।
ঘরের মধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার সময় নাকি হঠাৎ করে সারা ঘর উৎকট গন্ধে ভরে উঠত। বিশ্রী গন্ধে ঘরে টিকে থাকতে পারতেন না অতিথিরা। আবার কখনও ভেসে আসত ল্যাভেন্ডার ফুলের সুবাস। গন্ধগুলির উৎসস্থল হাজার চেষ্টা করেও খুঁজে পেতেন না অতিথিরা।
কানাঘুষো শোনা যায়, অতিথিরা নাকি হঠাৎ করেই তাঁদের শরীরে নানা জায়গায় দাগ লক্ষ করতেন। দেখে মনে হত যেন কেউ জোর করে আঁচড় কেটে দিয়েছেন। কেউ কেউ নাকি আঁচড়ানোর অনুভূতিও টের পেয়েছেন। অতিথিদের দাবি, নিজে থেকেই শরীরে প্রকট হয়ে যেত সেই দাগ।
ধীরে ধীরে হোটেলে অতিথিদের যাতায়াত কমতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪১ সালে হোটেলটি সেনাদের আবাসন হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। তিন বছর সেনারা হোটেলটি ব্যবহার করার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬৩ সালে আবার নতুন করে হোটেল খোলা হয়। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলার পর হোটেলটিতে সম্পূর্ণ ভাবে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করতে থাকেন, বেকার হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেখানে ‘প্রেতাত্মা’দের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
হোটেলে যে মানসিক রোগীরা থাকতেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মারাও যেতেন। স্থানীয়দের একাংশের অনুমান, রোগীদের ‘অতৃপ্ত আত্মা’ এখনও হোটেলের ভিতর ঘোরাফেরা করছে।
হোটেলের প্রথম মালিক টিডি বেকার এবং তাঁর স্ত্রী হোটেলের ভিতরেই থাকতেন। বেকার হোটেলে থাকাকালীন অবস্থাতেই নাকি তাঁদের মৃত্যু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রথম মালিক এবং তাঁর স্ত্রীর ‘প্রেতাত্মা’ এখনও হোটেলে তাণ্ডব চালায়।
টেক্সাসের বুকে একটি ‘ভূতুড়ে’ হোটেল বহু বছর বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে জেনে সেখানে ভিড় জমাতে থাকেন ‘অশরীরী শিকারি’দের দল। এমনকি ভূতের দেখা পাওয়ার উদ্দেশে সেখানে গভীর রাতে বহু ট্যুর গাইড ‘ঘোস্ট ওয়াক’-এর আয়োজন করে থাকেন।
ট্যুর গাইডেরা নাকি হোটেলে প্রবেশ করার আগে মূল ফটকের কড়া নাড়েন। তাঁদের দাবি, টিডি বেকারের ‘আত্মা’ এখনও সেখানে রয়েছেন। তাঁর অনুমতি না নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করলে ‘প্রেতাত্মা’দের ক্ষোভে পড়তে পারেন সকলে।
স্থানীয়েরা জানান, হোটেলের ১১ তলায় নিজের স্যুটে হঠাৎ মারা যান টিডি বেকার। স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি বলে হোটেলের ৭ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান মালিকের স্ত্রীও।
বন্ধ হোটেলে যাঁরা গভীর রাতে প্রবেশ করেন, তাঁরা নাকি গাউন পরা এক সুন্দরী মহিলাকে দেখতে পান। ল্যাভেন্ডার ফুলের গন্ধও নাকি তাঁদের নাকে ভেসে আসে। তাঁদের অনুমান, ওই মহিলা টিডি বেকারের স্ত্রী। তিনি ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি ব্যবহার করতেন বলে আচমকা ঘরে ফুলের গন্ধ ভেসে ওঠে।
‘অশরীরী শিকারি’দের দাবি, বর্তমানে কোনও পুরুষ হোটেলে প্রবেশ করলে তাঁরা সব সময় অদৃশ্য কোনও কিছুর উপস্থিতি টের পান। নরম হাতের আলতো স্পর্শও নাকি অনুভব করেছেন একাধিক পুরুষ। তাঁদের দাবি, টিডি বেকারের স্ত্রীর ‘প্রেতাত্মা’ নাকি পুরুষদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে।
এক এক সময় হোটেলের ভিতর থেকে কাচের ভাঙা টুকরোও পাওয়া যায়। কাচের গায়ে লেগে থাকে লাল লিপস্টিকের দাগ। একাংশের দাবি, এ-ও নাকি মালিকের স্ত্রীর ‘প্রেতাত্মা’র কারসাজি।
বেকার হোটেলে এমন বহু মানসিক রোগী যেতেন, যাঁরা সুস্থ হওয়ার আশায় দিনের পর দিন সেখানে কাটিয়েছেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, জল পান করেই রোগ সারিয়ে তুলবেন। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে হোটেলেই প্রাণ ত্যাগ করেন একাধিক রোগী।
টিডি বেকার এবং তাঁর স্ত্রী-সহ মৃত রোগীদের ‘অতৃপ্ত আত্মা’ বেকার হোটেলে বন্দি হয়ে রয়েছেন বলেই স্থানীয়েরা বিশ্বাস করেন। কিন্তু একাংশের মতে, এ সবই গুজব। হোটেলটি আবার নতুন করে তৈরি করে চালু করার চিন্তাভাবনাও চলছে।