‘প্রেমিকা’ পাকিস্তানের চর! দিল্লির সেনা ভবনের কর্মী ৩১ বছরের রবিপ্রকাশ মীনা জেলে বসেও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
দিনের পর দিন বহু অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছেন দু’জনে। ফোনে, ভিডিয়ো কলে যাপন করেছেন ঘনিষ্ঠ মূহূর্ত। মীনা ভেবেছিলেন তাঁর মতো তাঁর ‘প্রেমিকা’ও তাঁকে পাগলের মতো ভালবাসেন। মনের সব কথা ভাগ করে নেন। কিন্তু সেই ঘোর কাটল পুলিশ গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে মীনার বাড়িতে হাজির হওয়ার পর।
মীনা জানতে পারলেন, দেশদ্রোহী আইনে অভিযোগ দায়ের হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোপন তথ্য পাচার করার মারাত্মক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। সেনা সংক্রান্ত যে সব কথা তিনি জানিয়েছিলেন ‘প্রেমিকা’কে, সে সবই এখন তাঁর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাজতে তাঁকে এই অভিযোগের গুরুত্বই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তদন্তকারীরা। কিন্তু মীনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁর সঙ্গে সত্যিই পরিচয় গোপন করে প্রতারণা করেছেন তাঁর ‘প্রেমিকা’।
রাজস্থানের কারাউলি জেলার সাপোতারা গ্রামের বাসিন্দা মীনা দিল্লির সেনা ভবনের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কৌশলগত এবং স্পর্শকাতর তথ্য পাকিস্তানের গুপ্তচরকে পাচার করার অভিযোগ উঠেছে। প্রসঙ্গত, এই একই অভিযোগে গত পাঁচ বছরে আরও ৩৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এঁদের অনেকেই সেনাকর্মী। এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও মহিলার সঙ্গে সম্পর্কের প্রলোভনে জড়িয়ে ফাঁদে পা দিয়েছেন। পাক মহিলা গুপ্তচরদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে দুর্বল মুহূর্তে দিয়ে ফেলেছেন সেনা সংক্রান্ত জরুরি তথ্য। এই গুপ্তচরদের অনেকে পাকিস্তানের ইন্টারসার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের সদস্যও ছিলেন।
মীনার ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটে ফেসবুকের মাধ্যমে। অঞ্জলি তিওয়ারি নামে এক তরুণী নিজেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার পরিচয় দিয়ে কথাবার্তা শুরু করেন মীনার সঙ্গে।
অঞ্জলি জানিয়েছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত। রাজস্থানের বাসিন্দা এবং দিল্লিতে কর্মরত মীনার সঙ্গে ভিডিয়ো কলেও নিয়মিত যোগাযোগ হত তাঁর।
গত ৮ অক্টোবর রাজস্থানের ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ উমেশ মিশ্র গ্রেফতার করেন মীনাকে। উমেশ জানিয়েছেন, মীনা সেনা সংক্রান্ত তথ্য পাচার করতেন সামাজিক মাধ্যমে। তার বিনিময়ে নিয়মিত অর্থও আসত তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
উমেশ জানিয়েছেন, এর আগেও অর্থের বিনিময়ে তথ্য পাচারের অভিযোগ এসেছে। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে দেখা গিয়েছে, আর্থিক প্রস্তাবের পাশাপাশি সেনাকর্মীদের ফেলা হচ্ছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফাঁদে। তাঁদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে, মানসিক চাপ দিয়ে, ব্ল্যাকমেল করে তথ্য দিতে বাধ্য করা হত।
২০১৭ সালে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এ ধরনের অভিযোগে। কিন্তু তাঁদের কাউকেই সম্পর্কের ফাঁদে ফেলা হয়নি। তার পর ২০১৯ সালে গ্রেফতার হন ৬ জন। ২০২০ সালে ৫ জন, ২০২১ সালে ৮ জন এবং ২০২২-এ মীনাকে নিয়ে দশ জন গ্রেফতার হয়েছেন। উমেশ জানিয়েছেন, এঁদের অনেকেই পাক চরদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এই অভিযুক্তরা-সহ প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেট আইনে মামলা হয়েছে।
মীনার আগে এ বছরের শুরুতে ২৪ বছরের সেনাকর্মী প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধেও এই একই অভিযোগ উঠেছিল।
উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা প্রদীপ জোধপুরের সেনা শিবিরে মোতায়েন ছিলেন। প্রদীপও পাকিস্তানি গুপ্তচরদের ফাঁদে পা দেন। রিয়া নামে এক মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন প্রদীপ। ধরা পড়ার পর তাঁকেও দেখা গিয়েছিল হতভম্ব হয়ে যেতে।
মীনার মতো তিনিও বিশ্বাস করতে চাননি, যাঁর সঙ্গে ফোনে এবং ভিডিয়ো কলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত যাপন করেছেন, তিনি আসলে গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে মিশছিলেন তাঁর সঙ্গে।
গত মে মাসে প্রদীপের সঙ্গে যোগাযোগ হয় রিয়ার। নিজের পরিচয় দিয়ে রিয়া জানিয়েছিলেন, বেঙ্গালুরুর একটি সেনা হাসপাতালে কর্মরত তিনি। পদাধিকারে লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
প্রদীপ বিয়ে করতে চেয়েছিলেন রিয়াকে। রিয়াও তাঁর পরিবারের সঙ্গে প্রদীপকে ভিডিয়ো কলে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। কথা বলেছিলেন প্রদীপের বোনের সঙ্গেও।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রদীপকে প্রায়ই তাঁর কর্মক্ষেত্রের সমস্যার কথা জানাতেন রিয়া। সেই সব সমস্যা শুনে রিয়ার প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয় প্রদীপের। তিনি রিয়াকে সাহায্য করতে শুরু করেন।
এই সময়েই রিয়াকে সেনাবাহিনীর কাজের বিভিন্ন ড্রাফ্ট এবং নথি তৈরি করতে সাহায্য করতে শুরু করেন প্রদীপ। তিনি নাকি বুঝতেই পারেননি, সাহায্য করতে গিয়ে আসলে সেনাবাহিনীর গোপন নথি তিনি তুলে দিচ্ছেন এক পাক গুপ্তচরের হাতে।
মে মাসেই গ্রেফতার হন প্রদীপ। তাঁকে ঘটনাটির বিবরণ দেওয়ার চার দিন পরও প্রদীপ বিশ্বাস করতে চাননি, তিনি যাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন, তিনি এমনও করতে পারেন।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগে রিয়া নামের ওই পাক গুপ্তচর সেনাবাহিনীতে তাঁরই ইউনিটের আরও ১০ জনের সঙ্গে যোগযোগ করেন। কিন্তু কারও থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। শেষে প্রদীপ ফাঁদে পা দেন।
জুলাই মাসে রাজস্থানের বাসিন্দা ২৭ বছরের তরুণ নারায়ণ লাল গাদরি এবং ২৪ বছরের আরও এক তরুণ কুলদীপ সিংহ শেখাওয়াতকেও একই ধরনের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই ধরনের ঘটনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রায় একই ভাবে গড়িয়েছে।
প্রথমে ভিডিয়ো কল ভয়েস চ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ, তার পর ভালবাসার জালে জড়িয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত এবং ধীরে ধীরে নগ্ন ছবির আদানপ্রদান পর্যন্ত গড়াত ঘনিষ্ঠতা।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সব ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সামরিক তথ্য নেওয়ার জন্য হত তা নয়। অনেক সময় ভারতীয় সিম কার্ড, বা ভারতীয় মোবাইল নম্বরে হোয়াটস্যাপ অ্যাকাউন্ট খোলা এমনকি ওটিপি পাওয়ার জন্যও পাক চরেরা এ ভাবে ফাঁসিয়ে থাকেন ভারতীয় সেনাকর্মীদের।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা নজরে আসে গোয়েন্দাদের। কিন্তু কখনও যদি না আসে তা নিয়েই চিন্তায় ভারতীয় গোয়েন্দারা।
তবে পাক গুপ্তচরেদের এই ফাঁদে পড়ে যদি কোনও গুরুত্বপূর্ণ সেনা তথ্য বেহাত হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে দেশের বিপদ বাড়বে বলে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা।