যশ-অর্থ-খ্যাতি কে না পছন্দ করে! তবে কখনও কখনও খ্যাতির শিখরে উঠতে গিয়ে অনেক ভারী মূল্য চোকাতে হয় শিল্পীদের। তারকা হওয়ার মাশুল হিসেবে প্রাণও যায় অনেক নামীদামি শিল্পীর। এমনকি, খ্যাতির ভারে নির্মম ভাবে খুনও হতে হয়েছে বহু শিল্পীকে। সেই তালিকায় রয়েছেন বহু খ্যাতনামা গায়ক-গায়িকাও।
জেনে নিন, বিশ্বের এমনই ১০ বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর নাম, যাঁদের আততায়ীদের হাতে নির্মম ভাবে খুন হতে হয়েছে।
সম্প্রতি গুলি করে খুন করা হয় পাঞ্জাবি গায়ক তথা কংগ্রেস নেতা সিধু মুসে ওয়ালাকে। পাঞ্জাবের মানসা জেলার জাওহারকে গ্রামে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজদের গুলিতে নিহত হন। দু’-একটা নয়, ভরা বাজারের মধ্যে তাঁকে লক্ষ্য করে ৩০ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। এর ঠিক এক দিন আগেই মুসে ওয়ালার নিরাপত্তা আংশিকভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।
মুসে ওয়ালার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ গোটা সঙ্গীতজগৎ। তাঁকে খুনের অভিযোগ উঠেছে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের গোল্ডি ব্রারের বিরুদ্ধে। তবে তদন্তকারীদের অনুমান, এই হত্যাকান্ডের পিছনে প্রধান মাথা গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই।
১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট। টি-সিরিজের মালিক গুলশান কুমার তার লাল ওপেল গাড়ি থেকে নেমে ভারসোভার জিত নগরের বস্তির মাঝখান দিয়ে জিতেশ্বর মহাদেব মন্দির থেকে পুজো দিয়ে হেঁটে ফিরছিলেন। তখনই তাঁকে গুলি করা ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। তিন বন্দুকবাজের চালানো ১৬টি গুলি লাগায় ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর।
এই খুনের দায় বর্তেছিল দাউদ ইব্রাহিম নিয়ন্ত্রিত ডি-কোম্পানির উপর। ডি-কোম্পানির তরফ থেকে নাকি মোটা টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল গুলশনকে। কিন্তু গুলশন এই টাকা দিতে রাজি ছিলেন না। ভারী নিরপত্তার ঘোরাটোপে থাকায় তাঁকে ছুঁতে পারেনি আততায়ীরা। মৃত্যুর দিনে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীর শরীর খারাপ হয়। সেই সুযোগেই খুন করা হয় গুলশনকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, গুলি চালানোর আগে আততায়ীরা তাঁকে বলে, ‘‘অনেক পুজো করে নিয়েছ। এই বার উপরে গিয়ে পুজো কোরো।’’
পুলিশি তদন্তে এ-ও উঠে আসে যে, বলিউডের বিখ্যাত সুরকার নদিম সঈফিও গুলশনকে খুন করার জন্য আততায়ীদের টাকা দিয়েছিলেন। তবে এই ঘটনার পর নদিম দেশ ছে়ড়ে পলিয়ে যান। মনে করা হয়েছিল যে, গুলশনের সঙ্গে নদিমের ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। ২০০১ সালের ৯ জানুয়ারি তিন অভিযুক্তের মধ্যে আব্দুল রউফ মার্চেন্ট এই খুনের দায় স্বীকার করে। পরে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়।
নিউইয়র্ক শহরে এক মোহগ্রস্থ অনুরাগীর চালানো গুলিতে প্রাণ হারান ‘দ্য বিটলস্’ খ্যাত ব্রিটিশ গায়ক, গীতিকার, সঙ্গীতজ্ঞ জন লেনন । ৪০ বছর বয়সী শিল্পী তাঁর বিলাসবহুল বহুতল ‘ম্যানহাটান অ্যাপার্টমেন্ট’-এ প্রবেশ করছিলেন। সেই সময়েই মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামক এক ব্যক্তি চার বার গুলি করে। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই লেননের কাছে অটোগ্রাফ নিয়েছিলেন চ্যাপম্যান। চ্যাপম্যান জানিয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র খ্যাতি পাওয়ার লক্ষ্যেই তিনি জনকে খুন করেন। চ্যাপম্যানকে ২০ বছরের জেল হেফাজতের সাজা দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর হাতে প্রাণ যায় আমেরিকার র্যাপার টুপ্যাক শাকুরের। তিনি সঙ্গীত মহলে ‘২প্যাক’ নামে পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ২৫। নেভাদার লাস ভেগাসের একটি রাস্তায় রাত ১২টা নাগাদ তাঁর গাড়িটি ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়ায়। তখনই সাদা একটি গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালান বন্দুকবাজ। টুপ্যাকের বুকে চার বার গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় শিল্পীর।
পাকিস্তানের করাচিতে গুলি করে হত্যা করা হয় কাওয়ালি গায়ক আমজাদ সাবরিকেও। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথেই খুন করা হয় ৪৫ বছর বয়সি সাবরিকে। পরে, তাঁর মৃত্যুর দায় স্বীকার করে টিটিপি-র হাকিমুল্লাহ মেহসুদ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী ‘পাকিস্তানি তালিবান’ নামেও পরিচিত। ধর্মবিরোধী কথাবার্তা বলার কারণেই তাঁকে খুন করা হয় বলেও মেহসুদ গোষ্ঠী জানিয়েছিল।
খুন হতে হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের অন্যতম বিখ্যাত লাতিন গায়িকা সেলেনাকেও। সেলেনা ‘কুইন অব তেজানো’ নামেও পরিচিত ছিলেন। নিজের ‘ফ্যান ক্লাব’-এর সভাপতির বিরুদ্ধেই আর্থিক তছরুপের অভিযোগ আনেন সেলেনা। এই নিয়ে ‘ফ্যান ক্লাব’-এর সভাপতি সালদিভার সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয় সেলেনার। তখনই সেলেনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালান সালদিভা। এই গুলি তাঁর কাঁধে লাগে। তিনি পালাতে সক্ষম হলেও হোটেলের লবিতে আততায়ীর নাম জানিয়ে যান। কিন্তু পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যান সেলেনা।
২৫ মে হরিয়ানার রোহতক জেলার একটি হাইওয়ের কাছে মাটির নিচে থেকে উদ্ধার করা হয় ২৬ বছর বয়সি গায়িকা সঙ্গীতার মৃতদেহ। সঙ্গীতা ১২ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। সঙ্গীতা ওরফে দিব্যা দিল্লির বাসিন্দা। ইউটিউবে নিয়মিত ভাবে নিজের মিউজিক ভিডিয়ো প্রকাশ করতেন তিনি। সঙ্গীতাকে খুন করার অভিযোগে পুলিশ মেহাম থেকে রবি এবং অনিল নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। অভিযুক্তেরা পুলিশের জেরার মুখে হত্যার দায় স্বীকার করেছে।
আমেরিকার সিয়াটলের ব্যান্ড ‘দ্য গিটস’-এর প্রধান গায়িকা ছিলেন মিয়া জাপাটা। খুব অল্প সময়েই গায়িকা হিসেবে বিস্তর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মিয়া। ১৯৯৩ সালের ৭ জুলাই এক অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী তাঁকে ধর্ষণ করার পর খুন করে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্ত অনুযায়ী মিয়াকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ছিল ২৭। পরবর্তীতে জেসাস মেজকুয়া নামক এক ব্যক্তিকে মিয়াকে ধর্যণ এবং খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৮৪ সালে কানাডিয়ান-আমেরিকান গিটারিস্ট এবং সঙ্গীতজ্ঞ লেনি ব্রিউ-এর মৃতদেহ লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর বহুতলের ছাদের উপর সুইমিং পুলে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, শিল্পীকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। মামলাটি এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়েছে।
আমেরিকার বাসিন্দা, গায়ক ড্যারেল ল্যান্স অ্যাবট পরিচিত ছিলেন তাঁর মঞ্চ নাম ডাইমব্যাগ ড্যারেল নামে। ২০০৪ সালের ৮ ডিসেম্বর একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন ডাইমব্যাগ। ডাইমব্যাগকে খুন করেন তাঁরই এক অনুরাগী নাথান গেল। ডাইমব্যাগকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালান নাথান। ডাইমব্যাগ ছাড়া একাধিক মানুষ গুলির আঘাতে নিহত হন। অভিযুক্ত নাথান মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত ছিলেন বলেও পুলিশি তদন্তে উঠে আসে।