উঁচু পাহাড়, সর্বত্র ঘন সবুজ জঙ্গল। মাঝে বইছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ধারে এমনই দুর্গম এলাকায় হামলা করেছে চিনা সেনাবাহিনী।
সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) অতিক্রম করে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। তার পরেই দু’পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়।
শুক্রবার গভীর রাতে যেখানে সংঘর্ষ হয়েছে, সেই জায়গাটির নাম তাওয়াং। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ছোট্ট পাহাড়ি শহর এই তাওয়াংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, তাওয়াংয়ে ১১ হাজার মানুষের বাস। বছরে গড়ে প্রায় ৯১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এই অঞ্চলের গড় উষ্ণতা দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে শীত বাড়লে বরফ পড়তেও দেখা যায় তাওয়াংয়ে।
পাহাড়, নদী, গাছগাছালি— সব মিলিয়ে প্রকৃতি রূপের ডালি উজাড় করে দিয়েছে তাওয়াংয়ে। কিন্তু অরুণাচলের এই শহরে স্নিগ্ধতার মাঝে থেকে থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সংঘর্ষের বিষ। ভারত-চিন সীমান্ত শান্ত থাকে না।
প্রায়ই তাওয়াংয়ে অশান্তি লেগে থাকে। ভারতীয় সীমান্তের মাঝের এই অংশটিতে নিজেদের অধিকার দাবি করে প্রতিবেশী চিন। প্রায়ই তাদের সেনা সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে অশান্তি সৃষ্টি করে। রক্তাক্ত হয় কাঁটাতার।
অরুণাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগর থেকে প্রায় ৪৪৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত তাওয়াং। এর ঠিক দক্ষিণে রয়েছে তাওয়াং চু নদী। তাওয়াং নিয়ে গোলমালের শুরু ১৯১৪ সালে।
তাওয়াং প্রথমে ছিল তিব্বতের অধীন। ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে ১৯১৪ সালে তিব্বতের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে তাওয়াং-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা ভারতে ছেড়ে দিয়েছিল তিব্বত প্রশাসন।
চুক্তি অনুযায়ী, ভারত-তিব্বতের মাঝের সীমানা পরিচিত ছিল ম্যাকমাহন লাইন নামে। ১৯৫০ সালে তিব্বত যখন চিনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, তখন থেকে বিতর্কের সূত্রপাত। চিন সরকার তাওয়াং-সহ অরুণাচল প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভারতের অধিকার মানতে নারাজ।
১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধ চলাকালীন সাময়িক ভাবে তাওয়াং চিনের দখলে চলে গিয়েছিল। পরে ভারত সরকারকে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু চিন কখনওই তাওয়াংয়ে ভারতের অধিকার পুরোপুরি স্বীকার করেনি।
অভিযোগ, শুক্রবার গভীর রাতে তাওয়াংয়ের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে চিনা বাহিনী। পিএলএ-র অন্তত ৩০০ সেনা তাওয়াংয়ের ওই সেক্টরে অনুপ্রবেশ করেছিল।
চিনা বাহিনীর সঙ্গে ছিল পেরেক লাগানো লাঠি। তা নিয়ে ভারতীয় সেনার উপর হামলা করেন তাঁরা। তবে ভারতীয় সেনা প্রস্তুত থাকায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। এই সংঘর্ষে দু’পক্ষের বেশ কয়েক জন সেনা আহত হয়েছেন।
ভারতীয় সেনার ৬ জন আহত হয়েছেন শুক্রবার রাতের হামলায়। গুয়াহাটিতে তাঁদের চিকিৎসা চলছে। সূত্রের দাবি, চিনের তরফে আহত সেনার সংখ্যা আরও বেশি। পিটিআই জানিয়েছে, চিনা সেনারা তাওয়াংয়ে ঢুকে ১৭ হাজার ফুট উচ্চ একটি চূড়ার শীর্ষে ওঠার চেষ্টা করে। একটি ভারতীয় সেনা পোস্টও উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
তাতে বাধা দিলেই দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের পর দ্বিপাক্ষিক ঊর্ধ্বতন সেনা স্তরের আলোচনায় মুখোমুখি অবস্থান থেকে সেনা পিছিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
২০২০ সালের গত ১৫ জুন পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে অনুপ্রবেশকারী চিনা ফৌজকে ভারতীয় বাহিনী বাধা দেওয়ায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। সংঘর্ষে মোট ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলেন। আমেরিকা-সহ বিভিন্ন পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট চিনা সেনার নিহতের সংখ্যা ছিল আরও বেশি। যদিও তা প্রকাশ্যে শিকার করেনি বেজিং।
গালওয়ান-কাণ্ডের পরেও চিনা বাহিনীর এলএসি লঙ্ঘনের বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি উত্তর সিকিমের নাথুলায় অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে ভারতীয় সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে চিনা ফৌজ। অন্তত ২০ জন চিনা সেনা ওই সংঘর্ষে জখম হন।
এরও আগে ২০১৭ সালে প্রায় দুই মাস ধরে চলে ডোকলাম বিবাদ। ভারত-চিন-ভূটান সীমান্তে অবস্থিত ডোকা লা মালভূমি অঞ্চলকে ঘিরে উত্তেজনা হয়। চিনা সেনা সীমান্ত লঙ্ঘন করে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে বুলডোজার দিয়ে দু’টি বাঙ্কার ভেঙে দিয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। টহল দেওয়ার সময় ভারতীয় জওয়ানরা সীমান্ত লাগোয়া ওই বাঙ্কারগুলিতে বিশ্রাম নিতেন।
নিজেদের এলাকা না হওয়ার পরেও চিন সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় রাস্তা তৈরির চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ। সামরিক কৌশলগত কারণে ভারত তা আটকে দিতেই দু’পক্ষ মুখোমুখি হয়ে যায়। পরে অবশ্য আলোচনায় সমাধান মেলে।
গালওয়ান হোক বা তাওয়াং, দ্বিপাক্ষিক সেনাস্তরের ‘রুল অব এনগেজমেন্ট’ মেনে চিন বা ভারত কোনও পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি।