পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দু’বছর পর আবার সীমান্ত বিবাদ ঘিরে উত্তাপ ছড়াল ভারত ও চিনের মধ্যে। গত ৯ ডিসেম্বর, শুক্রবার অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং সেক্টরে ইয়াংৎসে এলাকায় দু’দেশের সেনার মধ্যে হাতাহাতি বাধে। দু’পক্ষের বেশ কয়েক জন জওয়ান জখম হয়েছেন বলে দাবি। তবে গলওয়ানের মতো এ বার প্রাণহানি ঘটেনি।
তবে এই প্রথম বার নয়, অরুণাচল প্রদেশের উপর চিনের নজর বহু বছর ধরেই রয়েছে। কেন অরুণাচল প্রদেশে বার বার আগ্রাসন দেখায় লাল ফৌজ?
১৯৫৪ সালে ‘নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’ (এনইএফএ) নামে পরিচিত ছিল এখনকার অরুণাচল প্রদেশ। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় অরুণাচলের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয় চিন। যুদ্ধে জয় ঘোষণার পর ম্যাকমাহন লাইন থেকে চিন সৈনিকরা ফিরে যান।
ম্যাকমাহন লাইন চিন-অরুণাচল সীমান্ত নামেই পরিচিত। যদিও এই ম্যাকমাহন লাইনের অস্তিত্ব মানে না ড্রাগনের দেশ। অরুণাচল প্রদেশকে বরাবরই নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে চিন। অরুণাচল দক্ষিণ তিব্বতের অংশ বলে দাবি করে বেজিং। তবে অরুণাচলের উপর ভারতের সার্বভৌমত্বের অধিকার আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত। কিন্তু তা মানতে রাজি নয় চিন।
১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি অরুণাচল প্রদেশকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তকমা দেওয়া হয়। এর পর ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের স্বীকৃতি পায় অরুণাচল।
উত্তর-পূর্বের সবচেয়ে বড় রাজ্য হল অরুণাচল। অরুণাচল প্রদেশে চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিবাদ চলছে বহুকাল ধরে। অরুণাচলের উত্তরে চিনের সঙ্গে রয়েছে বিতর্কিত সীমান্ত। পশ্চিম দিকে রয়েছে ভুটান। আর পূর্ব দিকে রয়েছে মায়ানমার। উত্তর-পূর্বের সুরক্ষা ঢাল বলা হয়ে থাকে অরুণাচলকে।
অরুণাচলের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে তাওয়াং জেলা। যেখানে ভুটান ও তিব্বতের সীমান্ত রয়েছে। তাওয়াং বরাবরই নজরে রয়েছে চিনের। বলা ভাল, এই অঞ্চলকে নিয়ে বরাবরই আগ্রহ রয়েছে শি জিনপিং সরকারের। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্বের অঞ্চলগুলিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাওয়াং গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বত ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মধ্যে তাওয়াং গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।
ষষ্ঠ দলাই লামার জন্মস্থান হল তাওয়াং। শুধু তাই নয়, তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে ভারতে গিয়ে তাওয়াংয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন চতুর্দশ দলাই লামা।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের মঠ রয়েছে। যার নাম ‘তাওয়াং গন্ডেন নামগিয়াল লাৎসে’। এই মঠের সূত্র ধরেই চিন দাবি করেছে যে, এক সময় ওই অঞ্চল ছিল তিব্বতের। এই মঠই তার প্রমাণ। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে তাওয়াং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
অরুণাচলের নিয়ন্ত্রণ যদি বেজিংয়ের হাতে যায় তা হলে সীমান্তের পূর্ব ও পশ্চিম, দুই প্রান্তেই ভুটানকে প্রতিবেশী হিসাবে পাবে চিন। যাতে লাভ হবে বেজিংয়ের। কেননা ভুটানের পশ্চিম প্রান্তের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে রাস্তা তৈরি করছে চিন। ডোকা লা থেকে গামোচিন পর্যন্ত রাস্তা সম্প্রসারিত করতে চায় ড্রাগনের দেশ। যেখানে পাহারা দেয় ভারতীয় সেনা।
শিলিগুড়ি করিডরের আরও কাছাকাছি আসা লক্ষ্য চিনের। যা ভারত ও ভুটান— দু’দেশের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে।
ভারত ও চিন— এই দু’দেশের কাছে অরুণাচল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে অরুণাচলই ভারতের সবচেয়ে নিকটবর্তী এলাকা। আবার চিনা বাহিনীর প্রতিরোধ দমন করতে বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করতে ভারতের কাছে অরুণাচল সবচেয়ে ভাল জায়গা।
উত্তর-পূর্বে ভারতের জল সরবরাহের পথে থাবা বসিয়েছে বেজিং। একাধিক জলাধার তৈরি করেছে চিন। যাকে ভূ-কৌশলগত অস্ত্র হিসাবে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে ড্রাগনের দেশ। যার জেরে এলাকায় বন্যা, খরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
ভারতের মধ্যে দিয়ে বয়েছে সাংপো নদী। যার উৎসস্থল তিব্বত। ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করার পর এই নদীর নাম সিয়াং। ২০০০ সালে তিব্বতে একটি বাঁধ ভাঙনের জেরে উত্তর-পূর্ব ভারতে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। নিখোঁজ হয়েছিলেন শতাধিক।
অতীতেও অরুণাচলের কাছে ইয়াংৎসে এলাকায় দু’দেশের সেনার মধ্যে সংঘাতের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। গত অক্টোবর মাসে চিনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ) ও ভারতীয় সেনার সংঘর্ষ বেধেছিল। তবে সে বার কেউ হতাহত হননি। একই রকম ঘটনা এর আগে ঘটেছিল ২০১৬ সালে।
তবে ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে সীমান্ত সংঘাত ঘিরে তেতে রয়েছে ভারত-চিন সম্পর্ক। সেই তিক্ত সম্পর্কের আবহেই গত ৯ ডিসেম্বর তাওয়াংয়ে দু’দেশের সংঘর্ষের ঘটনায় নতুন করে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও তলানিতে ঠেকল।