Tarun Niketan Kolkata

‘বিগ বি’ নাকি রোজ ঢুঁ মারতেন! দুই বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে আজও ‘যুবক’ শতবর্ষের ‘তরুণ নিকেতন’

ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ৭টায় দু’-তিন জন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে বের হন বাজার করতে। যত রকমের ভাল মাছ যেমন রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, বোয়াল, পার্শে, পাবদা, থেকে কই, পুঁটি। বাজার হয় তরুণ নিকেতনের জন্য।

Advertisement
অঙ্কিতা দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:২৯
Share:
০১ ২০

সকাল থেকেই ‘তরুণ নিকেতন’-এর হেঁশেলে যুদ্ধকালীন ব্যস্ততা। এক দিকে পঞ্চ ব্যাঞ্জনের প্রস্তুতি, আরেক দিকে মেনু ঠিক করে ফেলা। সেই অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ৭টায় দু’-তিন জন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে অরুণবাবু বেড়িয়ে পড়েন বাজার করতে। যত রকমের ভাল মাছ যেমন রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, বোয়াল, পার্শে, পাবদা, থেকে কই, পুঁটি। পেট টিপে, কানকো তুলে বিশুদ্ধ বাঙালি মতে বাজার হয় তরুণ নিকেতনের জন্য।

০২ ২০

লেক মার্কেট চত্বরে জহুরির চোখে পরখ করে নেন কোন মাছ ভাল, কোন মরসুমি সবজি সুস্বাদু, পাঁঠা নাকি মুরগি কোন পদের জন্য কী রকম উপকরণ দরকার সেই বুঝে বাজার সেরে ফেলেন সকাল সকাল। তবে মুরগির ডিম একেবারে বাদ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— এ নিয়মের অন্যথা হয় না।

Advertisement
০৩ ২০

প্রতি দিন অরুণদের হেঁশেলে ছ’-সাত রকম সব্জি হবেই। তাই মাথায় রাখতে হয় কোন সব্জি কতটা কিনতে হবে। মরসুমি সব্জি চোখের সামনে দেখতে পেলে তা-ও বেশ খানিকটা নিয়ে নেন। তবে এত বাজার একা হাতে বয়ে আনতে পারেন না। সঙ্গে দু’-তিন জন লোক থাকে। ওই কয়েক ঘণ্টা চরম ব্যস্ততার মধ্যে কাটে অরুণদের।

০৪ ২০

রাসবিহারীর মোড় থেকে ফুটপাত ধরে গড়িয়াহাটের দিকে কিছুটা যেতেই ডানহাতে ‘তরুণ নিকেতন’। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত এই পাইস হোটেল পা দিল ১০৮ বছরে। ‘দেব’-দের বৃহত্তর পরিবারও বটে।এক দিকে চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশ রাজত্বে অন্য দিকে কলকাতায় একটু একটু করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে মেস কালচার। গ্রাম, মফস্‌সল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা ছেলেদের সস্তায় দু’বেলা খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন তরুণ দেব।

০৫ ২০

দু’বেলা পেট ভরে খেতে না পাওয়ার কষ্ট কী, তা বুঝতে বেশি পড়াশোনা করতে হয়নি বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণকে। সেই শুরু। একবিংশ শতাব্দীর নামজাদা ফাইন ডাইনিং-কেও হার মানায় এখানকার খাবারের স্বাদ। তরুণ নিকেতনের তৃতীয় প্রজন্মের অরুণ দেব বলেন, “মেসবাড়িতে থাকা ছাত্র, সাত সকালে মফস্‌সল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা ছেলেপিলের দলের কথা মাথায় রেখেই এই হোটেল শুরু করেছিলেন দাদু। তাঁর মুখেই শোনা, সেই সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে বিখ্যাত মানুষের আনাগোনাও ছিল এখানে।”

০৬ ২০

অরুণ দেবের ছেলে অমরনাথ দেব বলেন, “তখন তো ছবি তোলার চল ছিল না। শুনেছি, বলিউডের ‘বিগ বি’ কলকাতায় চাকরি করতে এসে না কি এখানে খেয়ে তার পর অফিসে যেতেন। বাংলা ছবি ‘ফাটাফাটি’র শুটিং-ও তো এখানেই হল।”

০৭ ২০

বলিউডের ধারা অবশ্য এখনও চলছে। ‘যব উই মেট’ খ্যাত পরিচালক ইমতিয়াজ় আলির মুখে তরুণ নিকেতনর প্রশংসা অনেকেই শুনেছেন। পরিচালকের টিম ভাল করেই জানে, তিনি যতই নামী হোটেলে থাকুন না কেন, কলকাতা এলে তাঁর খাবার চাই তরুণ নিকেতনেরই।

০৮ ২০

তবে শুধু বলিউড কেন, টলিউডেরও অনেক অভিনেতা মাঝেমাঝেই এখানে ঢুঁ মারেন। কোনও একটা শীতের দুপুরে খেতে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতে পারে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় বা লোকনাথ দে-র সঙ্গে।

০৯ ২০

একেবারে ছাপোষা বাঙালির ঘরোয়া রান্না খাইয়ে ক্রমে কলকাতার সবচেয়ে পুরনো পাইস হোটেলের দলে নাম লিখিয়ে ফেলে এই তরুণ নিকেতন। ঝাঁ চকচকে অন্দরসজ্জা নেই। নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের হাওয়া।

১০ ২০

খসে পড়া পলেস্তারা চাপা দিতে হালের ‘অয়েল পেন্ট’ করা দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ১০০ বছরের ইতিহাস। ছোট-বড় নানা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন কেটে, বাঁধিয়ে টাঙানো রয়েছে দেওয়ালে। আগে মাটিতে চাটাই পেতে খাওয়াদাওয়ার চল ছিল।

১১ ২০

তবে এখন শ্বেত পাথরের টেবিল হয়েছে। রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ারও। খাওয়ার ঘর আর ভাঁড়ার ঘরের মাঝে পর্দা টাঙানো। তারই এক পাশে রয়েছে ছোট্ট খামার। গ্রাম থেকে আনা দেশি মোরগ, মুরগি রাখা থাকে এখানে।

১২ ২০

অমরনাথ বলেন, “কলকাতার বাজারে ভাল মানের দেশি মুরগি পাওয়া যায় না। তাই এই ব্যবস্থা।” হেঁশেল থেকে ক্রমাগত ভেসে আসা খাসির মাংসের সুবাস এবং প্রেশার কুকারে সিটি পড়ার আওয়াজ শুনে দেব বাড়ির চতুর্থ প্রজন্ম অমরনাথ দেব বললেন, “রাতের খাসিটা রান্না হচ্ছে এখন। ঢাকাই চিংড়ি পোলাও আর মাংসের বরাত রয়েছে। আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখলে আমরা লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিই।”

১৩ ২০

গড়িয়াহাটের হিন্দুস্তান পার্ক অঞ্চলে এখন দেব পরিবারের বাস। এই বাড়িরও একটি বিশেষত্ব রয়েছে। বাড়িতে হেঁশেল থাকলেও সেখানে রান্নাবান্না করার চল একেবারেই নেই। ক্রেতাদের জন্য যা রান্না করা হয়, তাই খেয়ে থাকেন দেব বাড়ির সদস্যেরা।

১৪ ২০

হাসতে হাসতে অমরানাথ বলেন, “আমরাও রোজ এখানকার রান্না খাই। আমাদের বাড়িতে রান্নাঘর আছে। কিন্তু সেখানে কোনও রান্না হয় না। অতিথিকে যা খাওয়াই, নিজেরাও তাই খাই। বাড়ির ছোটরাও তাই। পেটের সমস্যা হওয়ার ভয় নেই। কারণ, আমাদের রান্না বেশির ভাগটাই বাটা মশলায় করা হয়।”

১৫ ২০

কয়েক যুগ আগেও হিন্দু বাড়িতে মুরগির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। হোটেলেও সেই নিয়ম শুরু করেছিলেন তরুণ। কিন্তু খদ্দেরদের কথা মাথায় রেখে, তরুণ নিকেতনের হেঁশেলে মুরগির মাংস উঠলেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ডিম এখনও ব্রাত্য। চেনা-অচেনা, অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের ছাত্র মিলিয়ে প্রতি দিন প্রায় জনা পঞ্চাশের পাত পড়ে এখানে।

১৬ ২০

উৎসব-অনুষ্ঠানে তা আবার দ্বিগুণ হয়ে যায়। যাঁরা নিয়মিত আসেন, তাঁরা জানেন, এখানে মুরগির ডিমের কোনও পদই পাওয়া যায় না। বদলে মেলে হাঁসের ডিম। যে মরসুমে যা পাওয়া যায়, তা তো থাকেই।

১৭ ২০

যেমন— মটর ডাল মুলো দিয়ে, কচু শাক, কুমড়ো ফুল বা বকফুলের বড়া, নটে শাক, পুঁই শাক, সর্ষে দিয়ে ইলিশ, চিতল পেটি, পাতলা করে খাসির মাংসের ঝোল, দিশি মুরগি থেকে নিমবেগুন, চুনোমাছ কিংবা কাঁটা চচ্চড়ি, বাটামাছের ঝোল— সবই পাওয়া যায়। সারা বছর পাওয়া যায় কাঁচা আমের চাটনি। আর শীতকালে নলেন গুড়ের রসগোল্লা তো আছেই। আগে থেকে বললে পায়েসও পাওয়া যাবে।

ছবি: বং ফুডিজ

১৮ ২০

অনেক বাঙালির কাছে নিরামিষ খাবার মানে আবার পেঁয়াজ-রসুনও ব্রাত্য। তাঁদের কথা ভেবেই মাছ, মাংস বা ডিমের কোনও পদ ছাড়া আর কিছুতেই পেঁয়াজ-রসুন দেওয়া হয় না। প্রতি দিনের মেনু পরিবর্তন হওয়াই পাইস হোটেলের নিয়ম।

ছবি: বং ফুডিজ

১৯ ২০

তবে ডাল, তরকারি, মাছ, মাংসের সাধারণ পদগুলোয় কোনও পরিবর্তন হয় না। সাদা কাগজে পেন দিয়ে কাটা ছক। সেখানে অরুণবাবু লিখে রাখেন কোন টেবিলে, কী কী খাবার দেওয়া হয়েছে।

ছবি: রিয়েল ফেল্ভারস অফ বেঙ্গল

২০ ২০

সেই তালিকা মিলিয়ে বিল তৈরি করে, অনলাইনে টাকা নেওয়ার কাজ করতে করতেই অরুণ দেব বললেন, “থালি খাবার ইচ্ছে মাথায় নিয়ে এখানে এলে কিন্তু পস্তাতে হবে। এই হোটেলে তেমন কোনও নিয়ম নেই। সকাল-বিকাল নিজে হাতে বাজার করি। ভাত, ডাল, তরকারি— যা চাইবেন, তাই পাবেন। কিন্তু ধরাবাঁধা কোনও মেনু নেই। ফ্রিজে স্টোর করে রাখার প্রথা নেই। খাবার যাতে নষ্ট না হয়, সেই কথা মাথায় রেখে অফুরন্ত রান্না করা হয় না। তবে বেলা ৩টের মধ্যে এলে না খেয়ে ফিরতে হবে না। রাতে খোলা থাকে ১০.৩০টা পর্যন্ত।”

ছবি: রিয়েল ফেল্ভারস অফ বেঙ্গল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement