চিনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক বরাবরই আদায় কাঁচকলায়। পূর্ব চিন সাগরের উপর এই দ্বীপের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রতা কখনওই মেনে নেয়নি বেজিং। তবে তাইওয়ান বরাবরই নিজেদের স্বতন্ত্র দেশ হিসাবে দাবি করে এসেছে।
তাইওয়ানের এই স্বতন্ত্রতাকে ঘিরে বিতর্ক কম হয়নি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চিন। আকারে, লোকবলে, ক্ষমতায় তাইওয়ান এই বিশাল শক্তির কাছে নিতান্তই নগণ্য।
চিন তাই বার বার তাইওয়ানের সামনে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে। তাইওয়ান উপকূলে চিনের সামরিক মহড়া দফায় দফায় উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি করে পূর্ব চিন সাগরে।
গত কয়েক দিনে তাইওয়ানের প্রতি চিন অতিরিক্ত আগ্রাসী মনোভাব নিয়েছে বলে দাবি। সামরিক মহড়ার মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘন ঘন চিন থেকে তাইওয়ানের দিকে উড়ে যাচ্ছে ড্রোন এবং সামরিক বিমান।
চিনের হাবভাব দেখে ঝুঁকি নিতে চাইছে না তাইওয়ান। যে কোনও মুহূর্তে চিন তাদের আক্রমণ করতে পারে, তেমনটা ধরে নিয়েই প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করেছে তারা।
চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে তাইওয়ানের সামনে ‘আদর্শ’ হিসাবে উঠে এসেছে অন্য একটি দেশ। সম্মুখসমরে সেই দেশকেও নিজের থেকে বহু গুণ বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে যুঝতে হয়েছে। এখনও হচ্ছে।
কথা হচ্ছে ইউক্রেনকে নিয়ে। রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির যুদ্ধ চলছে। চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তারাই তাইওয়ানের সামনে ‘আদর্শ’।
ইউক্রেনের দেখানো পথেই এগোচ্ছে তাইওয়ান। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা যে পদক্ষেপ করেছে, যে পথে গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ, সেই পথেই তাইওয়ানও ঘুঁটি সাজাচ্ছে চিনের বিরুদ্ধে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। তার কয়েক মাস পর থেকেই কিন্তু তাইওয়ানে শুরু হয়ে গিয়েছিল তৎপরতা।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েন তাঁর দফতরের বরিষ্ঠ আধিকারিকদের নির্দেশ দেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের সফল প্রতিরোধের রহস্য কী, তা খুঁজে বার করতে হবে।
কিছু দিনের মধ্যেই ৭৭ পৃষ্ঠার রিপোর্ট জমা পড়ে সাইয়ের টেবিলে। এক কথায় যার সারবত্তা ছিল ড্রোন। আকাশপথে ড্রোনের ব্যবহারই ইউক্রেনকে প্রতিরোধের শক্তি জুগিয়েছে।
আধুনিক যুদ্ধে ড্রোন অত্যন্ত কার্যকরী সামরিক অস্ত্র হিসাবে উঠে এসেছে। ড্রোনের মাধ্যমে এক দিকে যেমন শত্রুশিবিরের উপর নজর রাখা যায়, তেমন গ্রেনেড হামলা বা যে কোনও বার্তাবহনেও এই যন্ত্র কাজে লাগে।
এর পর থেকে ড্রোনকেন্দ্রিক প্রতিরোধে জোর দেয় তাইওয়ান। ড্রোন তৈরি এবং সামরিক ক্ষেত্রে তার ব্যবহার আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে পূর্ব চিন সাগরের এই দ্বীপটিতে।
যদিও ড্রোন প্রযুক্তিতে চিনের ধারেকাছে নেই তাইওয়ান। চিনের কাছে মজুত ড্রোনে কমপক্ষে ৫০ ধরনের বৈচিত্র রয়েছে। সেখানে তাইওয়ানে আছে মাত্র চার ধরনের ড্রোন। সেগুলির সংখ্যাও খুব বেশি নয়।
চিনে ষাটের দশক থেকেই ড্রোন তৈরি এবং এই প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাইওয়ান এ বিষয়ে নতুন এবং কিছুটা অনভিজ্ঞ। তবে তাতে তারা দমে যাচ্ছে না।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট একটি ‘ড্রোন জাতীয় দল’ গঠন করেছেন। এই প্রকল্পের অধীনে তাইওয়ান ড্রোন নির্মাতাদের নিয়োগ করছে। নিজস্ব ড্রোন সাপ্লাই চেন গঠনে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
ড্রোনের জোগানে চিনকে পাল্লা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে তাইওয়ান। দিনরাত এক করে তাদের নির্মাতার পরিশ্রম করছেন। যত দ্রুত সম্ভব হাজার হাজার ড্রোন তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য।
তাইওয়ানের এই উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এক আধিকারিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘আমাদের যা করার দ্রুত করতে হবে। অনেক ড্রোন বানাতে হবে। আমরা আমাদের সেরাটা দিচ্ছি। আশা করি, শীঘ্রই আমরা ইউক্রেনের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারব।’’
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ৩,২০০টি উন্নত প্রযুক্তির সামরিক ড্রোন তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে তাইওয়ান। এই কাজে তারা দেশের বেসরকারি সংগঠনগুলিকেও শামিল করেছে।
তাইওয়ানে তৈরি ড্রোনগুলি মূলত আকারে অনেক ছোট। কিন্তু যুদ্ধের বিশাল ট্যাঙ্কার নিমেষে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হবে সেগুলি। চিনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানের এই প্রতিরোধ কতটা কার্যকরী হবে, তার উত্তর দেবে সময়।