দীর্ঘ দিন পাক সেনাবাহিনীর নজরদারির আওতায় ছিলেন। দফায় দফায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এ বার নিখোঁজই হয়ে গেলেন বালোচিস্তানের বারখান জেলার যুব সাংবাদিক আসিফ করিম খেতরান। অভিযোগ, পাকিস্তানের সেনাই গুম করেছে আসিফকে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লাগাতার হুমকির মুখে পড়েছিলেন আসিফ। এ বার তাঁকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়েছে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বালোচিস্তান তথা সারা পাকিস্তানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সংবাদমাধ্যম ‘বালোচিস্তান পোস্ট’-এর প্রতিবেদন জানিয়েছে, বারখান প্রেস ক্লাবের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত তথা পরিচিত সাংবাদিক আসিফকে শেষ বার দেখা গিয়েছিল ১৫ মার্চ। তার পর থেকে তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আসিফের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বেশ কয়েক জন মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবাদিকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন তাঁরা। আসিফের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার আইনজীবী ইমাম জয়নব মাজ়ারি-হাজ়ির। ইমাম জানিয়েছেন, আগেও একাধিক হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল যুব সাংবাদিককে।
মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স-এ একটি পোস্ট করে ইমাম লিখেছেন, ‘‘আসিফ করিম খেতরানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। ২০২৪ সাল থেকে আসিফ আমাকে বলে যাচ্ছিলেন যে, সেনাকর্তারা তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন। ভয় দেখাচ্ছেন। ওঁকে একটি সেনাছাউনিতে ডেকে নিয়ে যাওয়াও হয়েছিল। আসিফকে গুম করার আগে তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও অপহরণ করা হয়েছে।’’
বালোচিস্তান পোস্টের মতে, নিখোঁজ হওয়ার আগে আসিফ সমাজমাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে পাক সেনাবাহিনী তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর দোকান বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগও তুলেছিলেন তিনি। তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ তোলেন আসিফ।
অন্য দিকে, আসিফ অন্তর্ধান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনা বা বারখানের স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, সাংবাদিকদের জন্য ধীরে ধীরে অন্যতম বিপজ্জনক অঞ্চল হয়ে উঠছে বালোচিস্তান। মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা সম্পর্কিত সংবেদনশীল বিষয়গুলি নিয়ে খবর করতে গিয়ে তাঁরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। লাগাতার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অনেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ। যেমনটা হয়েছেন আসিফ। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেও তেমনটা দাবি করা হয়েছে।
আসিফ নিখোঁজ হওয়ার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা হিংসার নিন্দা করেছেন। অবিলম্বে এবং নিরাপদে আসিফকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দাবিও তুলেছেন তাঁরা।
সম্প্রতি, ‘বালোচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট’-এর মানবাধিকার বিভাগ ‘পাঙ্ক’-এর রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, গত মাস থেকে ১৩৪ জন রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলি পাকিস্তানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া না থাকা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিক্ষোভকারীরা সরকার, বিচার বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে এই সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে পদক্ষেপ করার জন্য ক্রমাগত আহ্বান জানিয়েছে বলেও খবর।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। গত দু’দিনে অন্তত ৫৭টি হামলার খবর পাওয়া গিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটির দায় স্বীকার করেছে কোনও না কোনও সন্ত্রাসবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। তবে সরকারের দেওয়া ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানের সঙ্গে ওই গোষ্ঠীগুলির পরিসংখ্যান মেলেনি।
পাকিস্তানে হামলাগুলির নেপথ্যে মূলত রয়েছে বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। এ ছাড়া, কিছু হামলার দায় স্বীকার করেছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)। পাক সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দু’দিনে বিদ্রোহীদের হামলায় দেশের নানা প্রান্তে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। আহতের সংখ্যা ৪৬ জন। তবে বিএলএ বা টিটিপির দাবি অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ১০০-র গণ্ডি পেরিয়েছে (বালোচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস অপহরণ সংক্রান্ত হতাহতের পরিসংখ্যান এর মধ্যে নেই)।
অভিযোগ, দু’দিনের হামলায় স্নাইপার থেকে শুরু করে গ্রেনেড বিস্ফোরণ কিংবা আইইডি বিস্ফোরণ, বিদ্রোহীদের নানা কৌশলের সাক্ষী থেকেছে পাকিস্তান। রবিবার বালোচিস্তানের কোয়েটায় পাক সেনাবাহিনীর কনভয়ে হামলা হয়েছিল।
এই ঘটনার দায় স্বীকার করে বালোচ বিদ্রোহীরা জানিয়েছেন, ৯০ জন পাকিস্তানি সেনা তাঁদের হামলায় নিহত হয়েছেন। যদিও সেনার তথ্য বলছে, হামলায় সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২১ জন। হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। ঘটনার পর পাক বাহিনী ওই এলাকায় হেলিকপ্টার এবং ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি শুরু করেছে।
কোয়েটার এই হামলার পর পাক-আফগান সীমান্তের গারিগাল থেকে আরও একটি হামলার খবর প্রকাশ্যে আসে। তাতে ন’জন সেনা গুরুতর জখম হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে টিটিপি। দেশের নানা প্রান্তে আরও কয়েকটি হামলার দায় তারা স্বীকার করেছে।
কিছু দিন আগে ৪৪০ জন যাত্রী নিয়ে পেশোয়ারের দিকে যাওয়ার পথে বালোচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস অপহরণ করা হয়েছিল। বহু যাত্রীকে পণবন্দি করেছিলেন বিদ্রোহীরা। তাঁদের মধ্যে শিশু এবং মহিলারাও ছিলেন। দীর্ঘ অভিযানের পর পাক সেনা জানায়, যাত্রীদের সকলকে নিরাপদে উদ্ধার করা গিয়েছে। নিহত হয়েছেন ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহী।
পরে সেই দাবি উড়িয়ে বিএলএ জানায়, তাদের হাতে ২১৪ জন যাত্রী বন্দি ছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এর পর পাক সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। সব মিলিয়ে, পাকিস্তানে অশান্তিতে কোনও ছেদ পড়েনি।
তবে পর পর হামলার ঘটনা সত্ত্বেও বালোচ বিদ্রোহীদের দমন করতে আপাতত বড় মাপের সেনা অভিযানের পথে হাঁটবে না পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সরকার। সোমবার পাক প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফে তেমনটাই জানিয়েছেন শরিফের রাজনৈতিক ও জনসংযোগ বিষয়ক মুখ্য উপদেষ্টা রানা সানাউল্লা। এ সবের মধ্যেই পরিচিত সাংবাদিককে গুম করা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে পাক সেনা।