সূর্যকুমার যাদব। ব্যাট করতে নামেন চার নম্বরে। স্ট্রাইক রেট থাকে দুশোর কাছাকাছি। কখনও বা তারও বেশি। রহস্যটা কী? সূর্যের জবাব ততোধিক সহজ। দল যদি বিপদে থাকে তা হলে বিপদ সামলে রানরেট বাড়িয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়া। আর দল যদি ইতিমধ্যেই অনেক রান করে ফেলে তা হলে সেই রানের গতি অব্যাহত রাখা। মুম্বইয়ের এই ব্যাটারকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা। গোটা বিশ্বে চলছে সূর্যের বন্দনা।
সূর্যের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবও ততোধিক চমকপ্রদ। ইংল্যান্ডের জোফ্রা আর্চারের আগুনে গতির বলকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে হুক করে গ্যালারিতে ফেলেছিলেন। বল গ্যালারিতে হারিয়ে যাওয়ার আগে গোটা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল, ভয়ডরহীন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ প্রদর্শনী শুরু হল। সেই সূর্যই এখন দুনিয়ায় পরিচিতি পাচ্ছেন কিংবদন্তি এবি ডিভিলিয়ার্সের পর দ্বিতীয় ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটার হিসাবে।
কিন্তু খেলার মাঠে সূর্য যেটা করেন, কী ভাবে করেন? কী করে পারেন এ ভাবে হেলায় অবিশ্বাস্য সমস্ত শট খেলতে! বিস্ময় ধরে রাখা কঠিন। সূর্যের খেলার ময়নাতদন্ত করলে দেখা যাচ্ছে মূলত দু’টি বিষয়। প্রথমত, বিপক্ষের বোলার, অধিনায়ক মাঠের ঠিক কোথায় ফিল্ডার রাখছেন। দ্বিতীয়ত, বোলার সেই ফিল্ডিং অনুযায়ী কোথায় কোথায় বল করতে পারেন সেই ধারণা। বাকিটা হাত এবং কব্জির খেলা!
সূর্যকুমারের ব্যাটিংয়ের মূল সম্পদ হল এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটে নামজাদা সকলের আগে শট খেলার জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার দক্ষতা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, অন্যান্য ব্যাটাররা যেখানে লেগস্টাম্প গার্ড নিয়ে আরও লেগের দিকে সরে গিয়ে জায়গা বানানোর চেষ্টা করেন, সেখানে সূর্য অফস্টাম্প ছেড়ে আরও বেরিয়ে যান। নিজের তিনটি স্টাম্প সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে। বোলার কোথায় বল করতে চলেছেন সেটা যেন বোলারেরও আগে জেনে যান সূর্য!
জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ২৫ বলে ৬১ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন সূর্য। সেই ইনিংসে সূর্যকে থামাতে নাগাড়ে অফস্টাম্পের বাইরে বল করে যাওয়ার কৌশল নেন রিচার্ড নাগারাভা। আশ্চর্যের বিষয় হল, রিচার্ড অফস্টাম্পের যত বাইরেই বল করুন না কেন, সূর্য তাকে কখনও সুইপ আবার কখন স্কুপ করে সেই লেগের দিকেই বাউন্ডারির বাইরে পাঠান। এ ক্ষেত্রে ব্যাটার ঠিক কী করতে চাইছেন, তা বুঝতে পেরেছিলেন বোলার। কিন্তু তাতেও কিছু করার ছিল না।
মাঠের কঠিনতম এই কোণে বল পাঠানোর সময় দেখা গিয়েছে, সূর্য কখনও কখনও চোখ বুজছেন। আবার কখনও শট মেরে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান শুনলে লজ্জা পেতে পারেন। লেগের দিকে স্কোয়ারের পিছনে খেলার ক্ষেত্রে সূর্য এখনও পর্যন্ত খেলেছেন মোট ১১১টি বল। রান করেছেন ৩৪০! এবং মাত্র ছ’বার আউট হয়েছেন। গড় ৫৬.৬৬ এবং স্ট্রাইকরেট ৩০৬.৩০। অর্থাৎ, প্রতি বলে তিন রানের বেশি। এবির কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক।
এ তো গেল লেগের কথা। অফেও এই অঞ্চলে সূর্যের একচ্ছত্র আধিপত্য। অফের দিকে স্কোয়ারের পিছনে সূর্যের গড় ৫৪.২০ এবং স্ট্রাইকরেট ২০৩.৭৬। এ বার এর সঙ্গে যোগ করুন উইকেটের পিছনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। এ ক্ষেত্রে সূর্যের ধারেকাছেও নেই কেউ। অন্তত ২০০ রান করেছেন এমন ব্যাটারদের তালিকায় সূর্য এক নম্বরে। স্ট্রাইকরেট ২৫০.৪০।
সূর্য একটি ভয়ঙ্কর সুন্দর আপারকাট খেলেন অনায়াসে। পয়েন্ট অঞ্চলের পিছন দিয়ে মারা এই শট তাঁর অস্ত্রভান্ডারের ব্রহ্মাস্ত্র। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হল, সূর্য এই শট খেলতে পারেন যদি বলের লেংথ এ দিকও দিক হয়ে যায়, তা-ও। তাঁর নমনীয়তা এমন জায়গায় যে, বল যদি ততটা শর্ট না-ও হয়, তা-ও হেলায় আপারকাট করে বল গ্যালারিতে ফেলতে পারেন সূর্য।
সূর্যের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় রত্ন হল, লেংথ যেমনই হোক, শরীরের নমনীয়তাকে ব্যবহার করে তিনি থাকতে পারেন নিশ্চল। মনে করুন, ক্রিস জর্ডন ফিল্ডারদের দিয়ে বাউন্ডারি ঘিরে কঠিন লেংথে বল করছেন। দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি ব্যাটার তাঁকে মিড অফের উপর দিয়ে ছক্কা মারার কথা ভাবছেন! কিন্তু সূর্যের ব্যাপারই আলাদা। ট্রেন্টব্রিজে জীবনের প্রথম শতরানের পথে তুলে মারা তাঁর অফ ড্রাইভ দেখে হতবাক ক্রিস কী ভেবেছিলেন জানা যায়নি। কিন্তু চমৎকৃত হয়েছিল ক্রিকেটবিশ্ব।
কাঁধের উচ্চতার শর্ট বলকে তরোয়াল চালানোর ভঙ্গিতে মিড অফের ফিল্ডারের পাশ দিয়ে পাঠাতে এই যুগে একমাত্র সূর্যই পারেন। এক বার নয়, বার বার। কাগিসো রাবাডার আগুনে ডেলিভারিতে মারা সেই ফোরহ্যান্ড পাঞ্চের স্থিরচিত্র দেখে অনেকেই বলছেন, যেন বোলারের ডেলিভারির অবস্থানে পৌঁছে যাচ্ছেন ব্যাটার!
অফ স্টাম্পের লাইনে বা তারও বাইরে ইয়র্কার এত দিন ছিল বোলারদের সবচেয়ে দামি অস্ত্র। সূর্যের কাছে ঘায়েল তা-ও। এক হাতে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের উপর দিয়ে যে শট মারেন সূর্য, তা দেখে ভ্যাবাচাকা লাগা ছাড়া আর কী হতে পারে!
কপিল দেবের ‘নটরাজ শট’ এক সময় ক্রিকেটবিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ধোনির হেলিকপ্টার শট নিয়েও প্রভূত আলোচনা হয়েছিল। ইদানীং সূর্যকুমার যাদব দেখাচ্ছেন, তিনি যাবতীয় অপ্রচলিত শটের ভান্ডার নিয়ে নেমে পড়েছেন ২২ গজে। বোলারদের নিস্তার নেই।