কলকাতা হাই কোর্টের দুই বিচারপতির বেনজির সংঘাত নিয়ে শনিবার সকালে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়। বিষয়টি শোনার জন্য পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে শীর্ষ আদালত।
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতিদের এই সংঘাতকে সুপ্রিম কোর্ট যে গুরুত্ব দিয়েই দেখছে, তা ছুটির দিনে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ বেঞ্চে শুনানির আয়োজন করা থেকেই স্পষ্ট। শুনানিতে এই সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন দেশের প্রধান বিচারপতি।
পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ছাড়াও ছিলেন বিচারপতি সঞ্জীব খন্না, বিচারপতি বিআর গাভাই, বিচারপতি সূর্যকান্ত, বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু। বিচারপতি সূর্যকান্ত ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি সৌমেন সেনের সংঘাতের আবহে সুপ্রিম কোর্ট উচ্চ আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দিয়েছে। আপাতত মেডিক্যালে ভর্তি মামলায় কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর মেডিক্যালে ভর্তি মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের সিঙ্গল এবং ডিভিশন বেঞ্চের কোনও নির্দেশ আপাতত কার্যকর হচ্ছে না। সোমবার আবার এই সংক্রান্ত শুনানি হবে শীর্ষ আদালতে।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা-ও স্থগিত থাকবে বলে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়।
অর্থাৎ, সিবিআই আপাতত মেডিক্যাল মামলায় তদন্ত করতে পারবে না। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানির পর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এই মামলায় রাজ্যকে নোটিস দিয়েছে শীর্ষ আদালত। নোটিস দেওয়া হয়েছে সিবিআইকেও। সুপ্রিম কোর্ট মামলাকারীকেও নোটিস দিতে বলেছে। প্রধান বিচারপতি জানান, মামলাকারী চাইলে মামলার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এই মামলায় যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে মামলার (এসএলপি) আবেদন জানায় রাজ্য। সুপ্রিম কোর্ট সেই অনুমতিও দিয়েছে। মামলাটি করা হয়েছে রাজ্যের তরফে।
সুপ্রিম কোর্টে শনিবার রাজ্যের পক্ষ থেকে ছিলেন আইনজীবী কপিল সিব্বল। আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি সওয়াল করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে।
অভিষেকের আইনজীবী সিঙ্ঘভি আদালতে জানান, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর অনেক নির্দেশেই অভিষেকের নাম টেনে আনেন। তাই তাঁর মক্কেলের বক্তব্যও শোনা হোক। লিখিত আকারে বক্তব্য জানাতে চান অভিষেক।
অভিষেকের আইনজীবীর বক্তব্য শুনে বিচারপতি জানান, সোমবার এই মামলার শুনানি যখন হবে, তখন তাঁর বক্তব্য শোনা হবে।
বিতর্কের সূত্রপাত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশকে কেন্দ্র করে। বিচারপতি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ ওই নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দেয়। পরে সিবিআইয়ের দায়ের করা এফআইআরও খারিজ করে দেয়।
এর পরেই ডিভিশন বেঞ্চের এই নির্দেশের প্রক্রিয়াগত ‘ত্রুটি’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি তাঁর নির্দেশনামায় বিচারপতি সেন সম্পর্কে একাধিক অভিযোগ তোলেন।
বিচারপতি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ যে নির্দেশ দিয়েছিল, তা-ও কার্যকর হবে না বলে জানিয়ে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এই মামলায় সিবিআইকে তিনি তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে বলেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নির্দেশনামায় উল্লেখ করেছিলেন, বড়দিনের ছুটির আগে বিচারপতি সেন তাঁর চেম্বারে বিচারপতি অমৃতা সিংহকে ডেকে পাঠান। সেখানে তিনি রাজনৈতিক নেতার মতো বিচারপতি সিংহকে নির্দেশ দেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, বিচারপতি সেন বিচারপতি সিংহকে বলেছিলেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রয়েছে। তাঁকে বিরক্ত করা চলবে না।’’
এ ছাড়া, বিচারপতি সেন বিচারপতি সিংহের এজলাসের ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ বন্ধ করতে হবে বলে জানান। নিয়োগ দুর্নীতির দু’টি মামলা খারিজ করতে হবে বলেও নাকি তিনি বিচারপতি সিংহকে বলেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ ছিল, বিচারপতি সেন ব্যক্তিগত স্বার্থে ওই সব নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তা খারিজ করে সিবিআইকে তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়, কেন বদলির নির্দেশ সত্ত্বেও বিচারপতি সেনের বদলি কার্যকর হচ্ছে না, নেপথ্যে কার হাত রয়েছে, সেই প্রশ্নও তোলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
বৃহস্পতিবার দুই বিচারপতির মধ্যে দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেওয়ার পর দেখা যায়, বিচারপতি সৌমেন সেনের বেঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত মামলা। রাতে হাই কোর্ট নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দেয়, আগামী সোমবার থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত মামলার শুনানি হবে অন্য ডিভিশন বেঞ্চে।
বেনজির সংঘাত দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট। শনিবার জরুরি ভিত্তিতে শুনানি ডাকা হয়। সেখানে মেডিক্যাল মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। (বিধিবদ্ধ অনুমতি সংগ্রহ করে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আদালতের এই শুনানিতে উপস্থিত ছিল আনন্দবাজার অনলাইন।)