লোকসভা ভোটের আগে নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অস্বস্তিতে বিজেপি। নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক বলল সুপ্রিম কোর্ট। তার সঙ্গে প্রকাশ্যে আসতে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলির অনুদানদাতাদের নামও। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ জানাল, নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প ‘অসাংবিধানিক’। তাই তা ‘বাতিল হওয়া উচিত’।
বৃহস্পতিবারের শুনানিতে শীর্ষ আদালতের তরফে জানানো হয়, নির্বাচনী বন্ড তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইনকে লঙ্ঘন করছে। নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থাকে ‘কুইড প্রো কুয়ো’ বলে মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ কোনও কিছুর বিনিময়ে কাউকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।
নির্বাচনী বন্ডে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি জানান, ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক (এসবিআই) এই ধরনের বন্ড দেওয়া বন্ধ করবে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে জমা পড়া অনুদান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তুলে দেবে।
সুপ্রিম কোর্টের তরফে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয়েছে, আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে কমিশনকে অনুদান সংক্রান্ত তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট আরও দু’টি নির্দেশ দিয়েছে। এক, ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া টাকা অনুদানদাতাকে ফেরত দেবে রাজনৈতিক দলগুলি। দুই, নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যাবতীয় তথ্য আগামী ৬ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে দেবে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক (এসবিআই)।
কমিশন এই অনুদান সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার পর তা প্রকাশ্যেও আনা হবে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত রিপোর্ট পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী প্যানেল অনুদান সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করবে। অর্থাৎ ১৩ মার্চের মধ্যে এই বিষয়ে তথ্য জানা যাবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ তার পর্যবেক্ষণে জানায়, কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে এবং অনুদানদাতাদের পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে— এই যুক্তিতে নির্বাচনী বন্ড চালু থাকতে পারে না। একই সঙ্গে সাংবিধানিক বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, কালো টাকা আটকানোর এটাই একমাত্র উপায় নয়।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি ছাড়া রয়েছেন বিচারপতি সঞ্জীব খন্না, বিচারপতি বিআর গাভাই, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র।
গত ২ নভেম্বরের শুনানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানান, বর্তমান ব্যবস্থায় অনুদানদাতা এবং অনুদানপ্রাপ্ত দল উভয়েই জানে দেওয়া-নেওয়ার কথা। বিচারপতি খন্না তখন মন্তব্য করেন, ‘‘শুধু ভোটারই জানেন না! এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন! সবটা খুলে দিচ্ছেন না কেন?’’
নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া মামলাগুলির শুনানিতে গত নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কারা শাসকদলকে আর্থিক সাহায্য করছে, সেই তথ্য গোপন রাখা গেলেও একই প্রকল্পে বিরোধীদের পাওয়া টাকার সূত্র প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে।
সেই সঙ্গে ‘রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক অনুদানের উৎস সম্পর্কে ভোটারের কিছুই জানার অধিকার থাকতে পারে না’— মোদী সরকারের ওই যুক্তিও খারিজ করে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।
প্রসঙ্গত, ভোটে কালো টাকার খেলা বন্ধ করার কথা বলে নির্বাচনী বন্ড চালু করেছিল মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৮ সালে প্রয়াত অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ডের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৭-র অর্থ বিলের মাধ্যমে আইনে একগুচ্ছ সংশোধনী এনে মোদী সরকার ২০১৮ থেকে নির্বাচনী বন্ড চালু করেছিল।
এর ফলে কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে, বন্ড কিনে সংশ্লিষ্ট দলকে দিতে হবে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ এবং ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক দলগুলি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু কে, কত টাকা দিচ্ছেন, তা বোঝা যাবে না। এই বন্ডের ফলে কর্পোরেট সংস্থার পাশাপাশি বিদেশিরাও টাকা দিতে পারতেন রাজনৈতিক দলগুলিকে। যার বিনিময়ে ব্যক্তি বা সংস্থা ১০০ শতাংশ করছাড় পেত।
নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পর বিষয়টির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বিরোধী দল এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, এতে অস্বচ্ছতাই বাড়বে। বিশ্বের কোনও দেশেই এমন ব্যবস্থা নেই, যেখানে বন্ড ভাঙাচ্ছে রাজনৈতিক দল। ফলে কোন কর্পোরেট সংস্থা কাকে ভোটে সাহায্য করছে, তার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দলের থেকে কী সুবিধা আদায় করছে, তা জানার কোনও উপায় নেই।
তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বন্ড-বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নির্বিবাদে অর্থ আমদানির কার্যত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে ফেলতে চাইছে বিজেপি শিবির। আর সে কারণেই তারা নির্বাচনী বন্ড চালু রাখতে মরিয়া। প্রায় ৫ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকা মামলা চলাকালীন ৫ জন প্রধান বিচারপতি এসেছেন। প্রতি বারেই মোদী সরকারের বন্ড-প্রীতি স্পষ্ট হয়েছে শীর্ষ আদালতে।
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, মূলত ১০ লক্ষ টাকা এবং ১ কোটি টাকার বন্ড কেনা হচ্ছে। যা থেকে স্পষ্ট, কর্পোরেট সংস্থাগুলিই রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চাইছে। আর সেই চাঁদা পাওয়ার নিরিখে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। অন্য দিকে, সরকারের যুক্তি, চাঁদা কারা দিচ্ছেন, তা প্রকাশ করতে গেলে এত দিনের মতো নগদে, কালো টাকার লেনদেনই হবে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি গড়ায় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে।
সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় সিপিএম এবং ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্র্যাটিক রাইটস’ (এডিআর) নামে একটি সংগঠন। তাদের আর্জি, নির্বাচনী বন্ড বিক্রি নিষিদ্ধ করা হোক, কিংবা বন্ড কারা কিনছে, তাদের নাম জানানো হোক। কিন্তু, দাতার নাম জানানোর দাবিতে সায় দিতে নারাজ ছিল কেন্দ্র।
এর আগের নিয়ম অনুযায়ী কোনও রাজনৈতিক দল এককালীন ২০ হাজার টাকা বা তার বেশি অনুদান পেলে বাধ্যতামূলক ভাবে দাতার নাম জানাতে হত। তবে বন্ড ব্যবস্থায় তা তুলে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে নির্বাচনী বন্ডের বিক্রি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হয়েছিল ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস’।
তখন বন্ড বিক্রিতে প্রথমে স্থগিতাদেশ দেওয়া হলেও পরে সেই আবেদন খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের নেতৃত্বাধীন ৩ বিচারপতির বেঞ্চ।