‘মমি’ তখনও ‘জাতে ওঠেনি’। তাদের নিয়ে বলার মতো গবেষণাও শুরু হয়নি। ইতিহাসবিদদের স্বীকৃতি পায়নি। এমন একটা সময়ে মিশরের খোলাবাজারে বিক্রি হত মমি। রাজা-উজির তো বটেই, কিনে নিয়ে যেতেন সাধারণ মানুষও। সে সব দিয়ে যা যা করা হত, এখন শুনলে হতবাক হতে হয়।
দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মিশর-সহ আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ইউরোপের মানুষের কাছে অজানা ছিল। মমি কী, সে সময় ইউরোপীয়রা জানতেন না। এমনকি একটা সময়ে মিশরীয়রা নিজেরাও এর গুরুত্ব বুঝতেন না।
১৭৯৮ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানের সেনা মিশরে পা রেখেছিল। প্রথমে তারা আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করে। তার পর ক্রমে গোটা উত্তর মিশর দখল করে। সে সময়ই মিশরের ইতিহাস বাকি ইউরোপ-সহ গোটা দুনিয়ার সামনে প্রকাশিত হয়।
তার পরেই আস্তে আস্তে পশ্চিমের দেশগুলির ‘কৌলিন্য’ অর্জন করে মমি। তার আগে মিশরের রাস্তায়, হাটেবাজারে বিক্রি হত মমি। যিনি পারতেন, কিনে নিয়ে যেতেন। সে রকম বেশ কিছু ছবিও দেখতে পাওয়া যায়।
উনিশ শতকে ধনীরা মিশরের বাজার থেকে মমি কিনে নিয়ে গিয়ে রীতিমতো পার্টির আয়োজন করতেন। তার নাম ছিল ‘মমি আনর্যাপিং পার্টি’। কী হত সেই পার্টিতে? উৎসুক জনতা উপস্থিত থাকতেন। তাঁদের সামনে খুলে ফেলা হত মমিতে জড়ানো রাসায়নিক মেশানো কাপড়।
লোকজন হামলে পড়ে দেখতেন, কী রয়েছে সেই মোড়কের আড়ালে। হাততালিতে ফেটে পড়তেন। অনেকেই আশা করতেন, যদি দামি ধাতু বা পাথর উদ্ধার হয়। এর সঙ্গে চলত খাওয়াদাওয়া এবং তুমুল হইহুল্লোড়।
মমি নিয়ে আরও কাণ্ড হত সে সময়। নানা কাজেও ব্যবহার করা হত মমি। উনিশ শতকে পিরামিড খুঁড়ে প্রায়ই এক-আধটা মমি বার করতেন মিশরীয়রা। সেই মমি গুঁড়ো করা হত। সেই গুঁড়ো ওষুধ হিসাবে খাওয়ার রীতি ছিল।
এই মমি চূর্ণের ব্যবসা গজিয়ে উঠেছিল অষ্টাদশ, উনিশ শতকে। শোনা যায়, বিদেশেও নাকি রফতানি করা হত মমি চূর্ণ। মানুষের ধারণা ছিল, সেই চূর্ণ খেলে শরীরের সমস্ত রোগ চলে যাবে।
সেই মমি চূর্ণের চাহিদা এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, জোগান কমে যাচ্ছিল। কিছু অসাধু লোক এই সুযোগে ব্যবসা শুরু করেন। ভবঘুরেদের মেরে সেই মাংস শুকিয়েও মমির গুঁড়ো বলে বিক্রি করতেন বলে শোনা যায়।
এর পর ধীরে ধীরে শিল্প বিপ্লব ঘটতে থাকল ইউরোপের দেশগুলিতে। তখনও অদ্ভুত ভাবে ব্যবহার হতে শুরু করে মমি। চাষের কাজে সার হিসাবে ব্যবহার করা হত । মমি গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেওয়া হত ক্ষেতে। সার হিসাবে নাকি দারুণ উর্বর ছিল সেই গুঁড়ো।
সারের জোগান দেওয়ার জন্য মিশর থেকে জাহাজে তোলা হত মমি। সেগুলি পাঠিয়ে দেওয়া হত জার্মানি, ইংল্যান্ডে। সে দেশে তখন দারুণ চাহিদা মিশরের মমির। সে সব বিক্রি করে ধনী হতে থাকেন মিশরের এক দল ব্যবসায়ী। চোর, ডাকাতেরা পর্যন্ত মমি হাতিয়ে বিক্রির চেষ্টায় থাকত।
মমি একটা সময় আমেরিকাতেও পাড়ি দিত। সেখানে আবার অন্য কাজে ব্যবহার হত প্রাচীন মিশরীদের এই সংরক্ষিত দেহাবশেষ। কয়েক হাজার বছর আগে দেহের উপর ওষুধে ভেজা কাপড় জড়িয়ে মিশরে তৈরি হত মমি। সেই মমির আবরণ কাগজ তৈরির কাজে ব্যবহার হত আমেরিকায়।
সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন জানিয়েছিলেন, জ্বালানি হিসাবেও নাকি ব্যবহার হত মমি। রেল ইঞ্জিন চালানোর জন্যও এই মমি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করা হয়েছে এমন ঘটনাও শোনা যায়।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ধীরে ধীরে মর্যাদা আদায় করে নেয় মমি। এক দল মানুষ বুঝতে পারেন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। আর তখন থেকেই ভাগ্য বদলাতে শুরু করে মমিদের। তবে তার আগেই অবশ্য মমি সাম্রাজ্য প্রায় উজাড় হয়ে গিয়েছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপ, আমেরিকার গণ্যমান্যেরা মিশর থেকে মমি কিনতে শুরু করেন। তার পর সেগুলিকে দেশে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে রাখতেন নিজেদের বসার ঘরে। এতে সামাজিক মানমর্যাদা বাড়ত তাঁদের।
মিশরে বেড়াতে এসে ব্রিটেন, আমেরিকার নাগরিকেরা স্মারক হিসাবেও কিনে নিয়ে যেতেন মমি। অনেকেরই গোটা মমি কেনার ক্ষমতা ছিল না। তাঁরা মমির অংশ কিনে নিয়ে ফিরতেন। এই যেমন একটা হাত বা মাথা বা পা। সে সব কিনে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে রাখতেন নিজেদের বাড়িতে।
ব্রিটেন, আমেরিকার অনেক বাসিন্দাই মিশর থেকে কম দামে মমি কিনে নিজের দেশে বেশি দামে বিক্রি করতেন। চলত কালোবাজারি, চোরাচালানও।
এ সব করতে করতে এক সময় মমির জোগানে টান পড়ে। মিশরে ক্রমেই কমে আসে মমির সংখ্যা। তাতেও কালোবাজারিতে ভাটা পড়েনি। ইউরোপ, আমেরিকার বহু ব্যবসায়ী হতদরিদ্র পরিবার থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করতেন। তার পর সেগুলি বালির নীচে চাপা দিয়ে রাখতেন। রোদে পুড়িয়ে মমির আকার দিতেন। তার পর বিক্রি করতেন।
কৃত্রিম ভাবে তৈরি এই মমির রং হত খয়েরি রঙের। এগুলিকে মমি ব্রাউনও বলা হত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুনিয়ার সংগ্রহশালায় থাকা অনেক মমিই আসলে ষোড়শ, সপ্তদশ শতকে বা তারও পরে তৈরি করা হয়েছে।
বিশ শতকে এসে এই মমি তৈরি বন্ধ করে কালোবাজারিরা। কারণ তত দিনে মিশরে মমি প্রায় নিঃশেষিত। ফলে লোক ঠকিয়ে আর কৃত্রিম মমি বিক্রি করা যাচ্ছিল না।