সুকুমার রায়ের ‘একুশে আইন’ ছড়াটির কথা মনে পড়ে? ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে’ সমস্ত আইনকানুন বড়ই অদ্ভুত। কেউ পিছলে পড়লেও তাঁকে একুশ টাকা দণ্ড দিতে হয়। আবার সন্ধ্যা ৬টার আগে হাঁচতে গেলেও টিকিট কাটতে হয়। তেমনই এক এক দেশে এক এক নিয়ম। কোনও কোনও দেশে যে কাজের জন্য কোনও শাস্তি হয় না, অন্য দেশে সেই কাজ-ই অপরাধ হিসাবে দেখা হয়। জাপানে এমন অনেক অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়, যা অন্য দেশে কোনও অপরাধই নয়।
বর্ষার সময় রাস্তায় জল জমা হলে আমরা সাধারণত দু’দিকে খেয়াল করে তার পর রাস্তা পার হই। কিন্তু হঠাৎ কোনও দিক থেকে দ্রুত গতিতে গাড়ি এলে রাস্তার কাদাজল পথযাত্রীদের গায়ে গিয়ে পড়ে। এই ঘটনায় পথযাত্রীরা বিরক্ত হলেও গাড়ির চালকেরা দিব্যি গাড়ি চালিয়ে নিজেদের গন্তব্যস্থলে চলে যান। কিন্তু জাপানে এই কাজ করা মানেই শাস্তি।
বর্ষার সময় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলে যদি সামনে কোনও পথযাত্রী এসে পড়েন, তা হলে চালকদের গাড়ির গতি কমিয়ে দিতে হয়। গাড়ি চালিয়ে পথযাত্রীদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় যেন কোনও ভাবেই তাঁদের গায়ে কাদাজলের ছিটে এসে না পড়ে। কিন্তু যদি কোনও গাড়ির চালক এই নিয়ম না মেনে চলেন এবং গাড়ির গতি বেশি থাকার কারণে রাস্তা জমা জলের ছিটে পথযাত্রীর গায়ে লাগে, তা হলে ওই গাড়ির চালককে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকার কাছাকাছি জরিমানা দিতে হয়।
জাপানের অধিবাসীরা যখন তখন বাড়ির ডাস্টবিনে রাখা আবর্জনা নিয়ে বাইরে বেরোতে পারেন না। যদি কেউ মনে করেন মাঝরাতে বা ভোরের দিকে রাস্তার ধারে আবর্জনা ভর্তি ব্যাগ রেখে দেবেন এবং সকালে ময়লার গাড়ি এসে সেখান থেকে ব্যাগটি নিয়ে চলে যাবে— তা সম্ভব হয় না।
সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে এলাকায় আবর্জনা পরিষ্কার করতে আসেন পুরকর্মীরা, তখনই সকলকে আবর্জনা নিয়ে বেরোনোর নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। জাপানের রাস্তায় মাঝেমধ্যেই বন্য রেকুন ঘুরে বেড়ায়। তারা ওই জঞ্জালভর্তি ব্যাগ ছিঁড়ে রাস্তা আরও নোংরা করে ফেলতে পারে। এ ছাড়াও হঠাৎ করে ওই জঞ্জালের কারণে আগুনও লেগে যেতে পারে। তাই এই নিয়ম।
বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীরা একসঙ্গে কোথাও খেতে গেলে মাঝেমধ্যেই তাঁদের সুরাপান করতে দেখা যায়। কিন্তু কখনও কখনও খাওয়াদাওয়ার এই আসরগুলিতে এমন কয়েক জন উপস্থিত থাকেন, যাঁরা সুরাপান পছন্দ করেন না। অনেক সময় তাঁদের জোর করে মদ খাওয়ানো হয়। ভারত বা অন্য কোনও দেশে এই কাজ অপরাধযোগ্য না হলেও জাপানে একে অপরাধ বলেই ধরা হয়। কাউকে জোর করে মদ খাওয়ানোর উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে জাপানে।
‘ওয়াকি টকি’র মাধ্যমে খুব সহজেই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায়। কিন্তু জাপানে এই নিয়েও রয়েছে কড়া নিয়ম। অন্য দেশ থেকে ‘ওয়াকি টকি’ কিনে নিয়ে গিয়ে জাপানে ব্যবহার করা যায় না।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদানের জন্য জাপান তাদের রেডিয়ো নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করে। অন্য দেশের ওয়াকি টকি জাপানে ব্যবহার করলে সেই নেটওয়ার্কে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। কেউ যদি নির্দেশ অমান্য করেন তা হলে ১ বছরের হেফাজত বা ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ৬ লক্ষ ৩১ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
মিনি স্কার্ট অথবা বিকিনি ড্রেস— এ ধরনের যে কোনও কম দৈর্ঘ্যের পোশাকে পায়ের কিছুটা অনাবৃত অংশ দেখা যায়। জাপানে ১৯৪৮ সালে ‘লাইট ক্রাইমস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, কোনও মহিলা ঊরু এবং পায়ের পিছনের অংশ জনসমক্ষে কখনও অনাবৃত রাখতে পারেন না। যদি কেউ এই নির্দেশ অমান্য করেন, তবে তাঁর ২৯ দিন পর্যন্ত জেল হতে পারে। তবে, বর্তমানে এই নিয়ম মেনে কেউ চলেন না। কালের প্রভাবে সব রকম পোশাকেই জাপানিরা অভ্যস্ত।
১৯৬০ সাল পর্যন্ত জাপানের রাস্তায় সাদা এবং লাল রঙের গাড়ি চালানো এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। রাস্তায় ইমার্জেন্সি কার, অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশ অথবা দমকলের গাড়ির ক্ষেত্রে সাদা এবং লাল রং ব্যবহার করা হত। প্রাইভেট গাড়ির থেকে ওই গাড়িগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিতকরণের সুবিধার জন্য এই নিয়ম চালু করা হয়েছিল। অবশ্য এই নিয়ম এখন আর মেনে চলা হয় না।
২০০৮ সালের জাপানের মেটাবো আইন অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর সকলকে তাঁদের কোমরের মাপ পরিমাপ করাতে হয়। বছর চল্লিশের গণ্ডি পেরোলেই কোমর বছরে অন্তত এক বার পরিমাপ করানো জরুরি।
পুরুষদের ক্ষেত্রে কোমরের মাপ ৮৫.০৯ সেন্টিমিটার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৮৯.৯২ সেন্টিমিটার থাকা উচিত। যদি কোমরের পরিমাপ এর থেকে বেশি হয়, তা হলে শরীরচর্চা এবং ডায়েটের মাধ্যমে আবার সঠিক মাপে ফিরিয়ে আনা আবশ্যক। সাধারণত ৪০ থেকে ৭৪ বছর পর্যন্ত পরিমাপ করাতে হয়।
প্রতিবেশীর চিঠি যদি ভুল করে আপনার বাড়িতে চলে আসে, তবে নির্দিষ্ট বাড়িতে আমরা তা দিয়ে আসাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিন্তু জাপানে ওই কাজ অপরাধের সমান।
জাপানের আইন অনুযায়ী, ভুলবশত প্রতিবেশীর চিঠি পৌঁছে গেলে তা আবার ডাকঘরে দিয়ে আসতে হয়। ডাকঘরের তরফ থেকেই আবার সেই চিঠি সঠিক ঠিকানায় পাঠানো হবে। প্রেরক এবং প্রাপকের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা কাজের কারণে শুধু মাত্র জাপানে দম্পতিরা আলাদা বাড়িতে থাকতে পারেন। এ ছাড়া কোনও দম্পতির আলাদা ভাবে দীর্ঘ দিন পৃথক জায়গায় থাকার অনুমতি নেই। জীবনযাত্রার খরচ এবং বিচ্ছেদের সংখ্যা কমাতেই এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।