পেদ্রো আলোনসো লোপেজ। যার নাম শুনলে এখনও শিউড়ে ওঠেন কলম্বিয়ার মানুষ। সে দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ানক সিরিয়াল কিলার হিসাবে লোপেজের নাম জ্বলজ্বল করছে পুলিশের খাতায়।
৪০০-র বেশি খুনের অভিযোগ রয়েছে লোপেজের বিরুদ্ধে। এখন তাঁর বয়স হওয়ার কথা ৭৪ বছর। কিন্তু লোপেজ কোথায়, তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কি না, এখন আর তা জানা যায় না। ১৯৯৮ সালে কলম্বিয়ার মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যেন বেমালুম উবে গিয়েছেন লোপেজ।
শুধু খুন নয়, নাবালিকাদের ধর্ষণ করতেন লোপেজ। তার পর মেরে ফেলতেন অনায়াসে। লোপেজের শিকার ছিল মূলত আদিবাসী নাবালিকারা। কলম্বিয়া পুলিশের তথ্য বলছে, ১৯৬৯ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে অন্তত ২০০ নাবালিকা তাঁর হাতে নিগৃহীত হয়েছে। সকলকেই নির্মম ভাবে খুন করেছেন লোপেজ। কলম্বিয়া, পেরু, ইকুয়েডর জুড়ে তাঁর মোট খুনের সংখ্যা ৪১০।
লোপেজের নামের সঙ্গে নৃশংসতা যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিল এক সময়। তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘আন্দিজের দানব’। পুলিশ, গোয়েন্দাদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই ধারাবাহিক খুনি।
১৯৯২ সালে ইকুয়েডরের জেলে বন্দি অবস্থায় লোপেজের একটি সাক্ষাৎকার নেন সাংবাদিক রন লেটনার। সেই সাক্ষাৎকার একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই কলম্বিয়ান এই সিরিয়াল কিলারের কীর্তি আলোড়ন ফেলে দেয় গোটা বিশ্বে। খুন, ধর্ষণের কথা নিজের মুখেই স্বীকার করেছিলেন লোপেজ।
জানা যায়, লোপেজের মা যৌনবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোট থেকে মাকে এই পেশায় দেখেছেন তিনি। লোপেজের শিশুমনে মায়ের কার্যকলাপ গভীর ভাবে দাগ কেটেছিল। যা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। ছোটবেলায় শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন লোপেজ।
১৯৫৭ সালে, নিজের ছোট বোনকে ‘আদর’ করতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায় আট বছরের লোপেজ। মা তাঁকে মারতে মারতে বাড়ি থেকে বার করে দেন। ছোট্ট লোপেজ পালিয়ে যায় রাজধানী শহর বোগোতায়। জীবনের মোড় ঘুরে যায় সেখানেই।
প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে লোপেজ দাবি করেন, বোগোতায় এক ব্যক্তি তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিলেন। ১২ বছর বয়সে আমেরিকার এক অভিবাসী পরিবারের হাতে পড়ে কিশোর লোপেজ। তাঁরা তাকে অনাথ আশ্রমে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। দু’বছর পর সেখান থেকেও পালিয়ে যায় সে। কেউ বলেন, ওই বয়সে আশ্রমের এক পুরুষ শিক্ষকের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন লোপেজ। কেউ আবার বলেন, শিক্ষকের সঙ্গেই পালিয়ে যান তিনি।
লোপেজ জানিয়েছেন, একটি গাড়ি চুরির অপরাধে জেল খাটার সময় কারাগারেই গণধর্ষণের শিকার হন তিনি। নির্মম ভাবে তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। এর পর ধীরে ধীরে তাঁর অন্তরের ‘দানব’ প্রকাশ্যে আসে। ধর্ষকদের জেলেই খুন করেন তিনি।
জেল থেকে বেরিয়ে পেরুতে চলে গিয়েছিলেন লোপেজ। সেখানেই ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের চিহ্নিত করে খুন করতে শুরু করেন তিনি। নিজেই জানিয়েছেন, ১৯৭৮ সালের মধ্যে ১০০-র বেশি নাবালিকাকে খুন করে ফেলেছিলেন তিনি। ওই বছর এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাতে প্রথম বার ধরা পড়েন লোপেজ। তাঁরা তাঁকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমেরিকার এক সাধু তাঁকে উদ্ধার করেন বলে দাবি। স্থানীয় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় লোপেজকে। সেখান থেকে দ্রুত মুক্তিও পেয়ে যান।
পেরু থেকে আবার কলম্বিয়া চলে আসেন লোপেজ। সেখান থেকে ইকুয়েডর যান। এই সময়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিন জন করে বাচ্চা মেয়েকে খুন করেছেন বলে জানিয়েছেন লোপেজ। তাঁর কথায়, ‘‘ইকুয়েডরের মেয়েগুলোকে আমার বেশি পছন্দ ছিল। ওরা খুব নিষ্পাপ, শান্তশিষ্ট। সহজেই বিশ্বাস করে নিত আমার কথা।’’
১৯৮০-র মার্চে অবশেষে ধরা পড়েন লোপেজ। এক নাবালিকাকে অপহরণের চেষ্টা ব্যর্থ হলে তাঁকে ধরে ফেলে পুলিশ। তত দিনে ২০০ নাবালিকাকে মারা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। মোট খুনের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে। শোনা যায়, তিনি নিজেই ৫৩ জন নাবালিকার কবরে পুলিশকে নিয়ে গিয়েছিলেন, যারা তাঁর নৃশংসতার শিকার হয়েছিল।
১৯৮০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ১৮ বছর জেল খাটেন লোপেজ। তার পর কলম্বিয়া সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর এক সাক্ষাৎকারে লোপেজ জানিয়েছিলেন, কারাগারে ভাল ভাবে থাকার জন্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিজেকে তিনি ‘শতাব্দীর সেরা ব্যক্তি’ বলেও দাবি করেছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের দাবি, লোপেজকে মানসিক ভারসাম্যহীন ঘোষণা করেছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। ইকুয়েডরের মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। ১৯৯৮ সালে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, লোপেজ সুস্থ। ৫০ ডলারের বন্ডে মুক্তি পান তিনি। তার কিছু দিন পরেই নিখোঁজ হয়ে যান লোপেজ।
২০০২ সালে নতুন একটি খুনের ঘটনায় লোপেজের নাম জড়ায়। কিন্তু পুলিশ তাঁকে আর খুঁজে পায়নি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০০৬ সালে লোপেজকে ‘সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলার’ আখ্যা দিয়েছিল। অপরাধকে মহিমান্বিত করার অভিযোগে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল। পরে লোপেজের সেই ‘রেকর্ড’ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।