‘হিন্দি ফিল্লমকে হিরো হ্যায় হাম, হামে কোই নেহি মার সকতা, হাম অমর হ্যায়’! বিখ্যাত এই সংলাপ ‘মির্জাপুর ২’-তে শোনা গিয়েছিল সিরিজ়ের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র (বলা ভাল সব থেকে জনপ্রিয় চরিত্র) ‘মুন্না ভাইয়া’র মুখে। মির্জাপুর মানেই ‘মুন্না ভাইয়া’র চরিত্রে দিব্যেন্দু ত্রিপাঠীর মুখে মুচমুচে সংলাপ, ধাঁই ধাঁই গুলি আর ভরপুর বিনোদন। এই গল্পের বাকি চরিত্রদের নিয়ে মাতামাতি থাকলেও খল চরিত্রে অভিনয় করেও দর্শকদের প্রিয় ‘মুন্না’। কিন্তু জানেন কি এক কালে সত্যিই অস্তিত্ব ছিল ‘মুন্না ভাইয়া’র। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে মির্জাপুর, জৌনপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ‘রাজ’ করেছিলেন।
মির্জাপুরের মুন্না ভাইয়ার সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে মুন্না বজরঙ্গি নামে উত্তরপ্রদেশের এক কুখ্যাত গ্যাংস্টারের। সেই গ্যাংস্টার মুন্নাই ছিলেন মির্জাপুরের ‘বেতাজ বাদশা’।
একটা সময় পর্যন্ত মির্জাপুর, জৌনপুর এবং বারাণসীর ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন গ্যাংস্টার মুন্না। সাধারণ মানুষ তাঁর নামে ভয়ে কাঁপত।
মুন্নার আসল নাম প্রেমপ্রকাশ সিংহ। পড়াশোনা করেছিলেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। এর পর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ভি়ড়ে যান ছোটখাট অপরাধীদের সঙ্গে। ‘প্রেম’ তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রতি।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
ওই কিশোর বয়সেই খুন এবং বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগে জেলে যেতে হয় মুন্নাকে।
অপরাধী হিসাবে ‘নাম’ কামানোর পর মুন্না জৌনপুরে গজরাজ সিংয়ের নেতৃত্বে একটি গ্যাংয়ে যোগ দেন।
নব্বইয়ের দশকে গজরাজের গ্যাং থেকে বেরিয়ে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের নিয়ন্ত্রণ রাখা মুখতার আনসারির দলে যোগ দেন মুন্না। গজরাজের থেকে বড় গ্যাংস্টার ছিলেন মুখতার। তাঁর অপরাধের পরিধিও ছিল অনেক বড়।
খুব কম সময়েই মুখতারের ডান হাত হয়ে উঠেছিলেন মুন্না। তাঁকে মউ জেলা সামলানোর দায়িত্ব দেন মুখতার।
মউ জেলায় তখন অন্য এক কুখ্যাত গ্যাংস্টার ছিলেন ব্রিজেশ সিংহ। এক জঙ্গলে দু’জন ‘সিংহ’ থাকতে পারে না। এই ধারণা থেকেই মুন্না এবং ব্রিজেশের গ্যাংয়ের মধ্যে গন্ডগোল লেগেই থাকত।
মুন্না এবং ব্রিজেশের গ্যাংয়ের এ রকমই এক সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে প্রাণ হারান বিজেপি নেতা কৃষ্ণানন্দ রাই। এর পর মুন্নার নামে আরও এক বিজেপি নেতা রামচন্দ্র সিংহকে খুন করার অভিযোগ ওঠে।
সময়ের সঙ্গে আরও বেড়ে যায় মুন্নার ক্ষমতা। দিন নেই, রাত নেই গোলাগুলি এবং খুন লেগেই থাকত তাঁর গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে। কিন্তু মুন্নাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না উত্তরপ্রদেশের পুলিশ।
অবশেষে মুন্নার মাথার দাম ধার্য করেছিল পুলিশ। ঘোষণা করা হয়েছিল, যে মুন্নাকে ধরিয়ে দেবেন, তাঁকে ৭ লক্ষ টাকা নগদ পুরস্কার দেওয়া হবে।
পুলিশের চাপ বাড়তেই প্রায় ৪০টি খুন এবং তোলাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত মুন্না ২০০৩ সাল নাগাদ সপরিবারে মুম্বইয়ে চলে যান।
এর পর দীর্ঘ দিন দিল্লি এবং মুম্বইয়ে গা ঢাকা দিয়ে থেকেছেন মুন্না। দলের সদস্যদের সঙ্গে অবশ্য নিয়মিত যোগযোগ রাখতেন। তবে মুন্না না থাকার কারণে তাঁর দল ধীরে ধীরে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা হারাতে থাকে। খুন হতে থাকে তাঁর দলের অনেক সদস্য।
মুন্নারও শেষরক্ষা হয়নি। ২০০৯ সালে মুন্না দিল্লিতে রয়েছেন বলে খবর পায় পুলিশ। এর পর তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়।
মুন্না বরাবরই মুলায়ম সিংহ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টির (এসপি) সমর্থক ছিলেন বলেই মনে করা হত। গ্রেফতারির পর রাজনৈতিক দিক থেকেও ক্ষমতা পাকাপাকি করার চেষ্টাও করেন তিনি।
২০১২ সালে, তিহার জেলে বন্দি থাকাকালীন মুন্না উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন। তবে এসপি-র হয়ে নয়, তাদের বিপক্ষে। মারিয়াহু বিধানসভা কেন্দ্র থেকে আপনা দল এবং পিস পার্টির যৌথ প্রার্থী হিসাবে লড়াইয়ে নামেন মুন্না। কিন্তু ভোটে হেরে যান।
পর্দার মুন্নার মতো বাস্তবের মুন্নারও মৃত্যু হয় গুলিতেই। তবে বাস্তবের মুন্নার মৃত্যু ছিল আরও নাটকীয়। জেলের ভিতরে মাথায় গুলি করে খুন করা হয় তাঁকে।
২০১৮ সালের ৮ জুলাই রবিবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ মুন্নাকে ঝাঁসি জেল থেকে বাগপত জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ জুলাই তাঁকে বাগপতের আদালতে পেশ করার কথা ছিল। ৯ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ জেলের মধ্যেই মুন্নার মাথায় গুলি চালান সুনীল রাঠি নামে অন্য এক সাজাপ্রাপ্ত। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মুন্নার।
সুনীলের দাবি ছিল, মুন্না তাঁকে জেলে ঢোকা থেকে মোটা বলে রাগাচ্ছিলেন। আর সেই কারণেই রাগের বশে তিনি মুন্নাকে খুন করেছেন।
মুন্নার মৃত্যু নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন এবং জেলের কর্তাদের বরখাস্ত করার কথা ঘোষণা করেন।