ক্যাথরিন নাইট। কুখ্যাত খুনিদের মতো একাধিক খুন তিনি করেননি। করেছিলেন একটি খুন। তবে ওই একটি খুনের নৃশংসতা এবং বিভীষিকার কারণেই অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম কুখ্যাত অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয় তাঁকে।
প্রেমিককে কুপিয়ে খুন করে এবং দেহ টুকরো টুকরো করে স্যুপ বানিয়ে খেয়েছিলেন ক্যাথরিন। সেই কাজের জন্য জঘন্যতম অপরাধীর তকমা পেয়েছিলেন ক্যাথরিন।
ক্যাথরিনের জীবন ছিল হিংসা এবং যৌন নির্যাতনে ভরা। তারই অন্তিম পরিণতি ছিল প্রেমিককে খুন।
১৯৫৫ সালের ২৪ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার টেনটারফিল্ডে ক্যাথরিনের জন্ম। ক্যাথরিনের মা বারবারা রাউহান বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বামীর বন্ধু কেন নাইটের সঙ্গে। সেই সম্পর্ক অনেক দূর অবধি গড়িয়েছিল। গর্ভবতী হয়ে পড়েন বারবারা। জন্ম নেন ক্যাথরিন।
ক্যাথরিন এবং কেনের সম্পর্কের গাথা ছোট্ট রক্ষণশীল শহর টেনটারফিল্ডে অচিরেই ছড়িয়ে পড়েছিল। বারবারা গর্ভবতী হতেই তাঁকে ছেড়ে চলে যান কেন। তাঁর স্বামী বারবারা এবং ক্যাথরিন দু’জনকেই আশ্রয় দেন। মুখে মেয়ে হিসাবে মেনে নিলেও মন থেকে ক্যাথরিনকে মেয়ে হিসাবে মানতে পারেননি বারবারার স্বামী এবং পরিবারের বাকি সদস্যরা।
বারবারার স্বামী সারা দিন মত্ত অবস্থায় থাকতেন এবং ক্যাথরিনের সামনেই বারবারাকে দিনে একাধিক বার ধর্ষণ করতেন। ক্যাথরিন দাবি করেছিলেন, পরিবারের বেশ কয়েক জন সদস্য বছরের পর বছর তাঁকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন।
নিজের উপর হওয়া নির্যাতনের ‘ঝাল’ স্কুলে অন্য বাচ্চাদের উপর মেটাতেন ক্যাথরিন। বাকি বাচ্চাদের মারধর করা এবং ভয় দেখানোর অপরাধে ক্যাথরিনকে স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয়। পরিবার থেকে তাঁকে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই কাজ ছেড়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ক্যাথরিন একটি কসাইখানায় কাজ করতে শুরু করেন।
মাংস কাটার কাজ ক্যাথরিন এতটাই পছন্দ করতেন যে, তিনি নাকি নিজের বিছানার কাছে সব সময় কসাইয়ের ছুরির একটি সেট ঝুলিয়ে রাখতেন।
কসাইয়ের দোকানে কাজ করার সময় ডেভিড কেলেটের সঙ্গে আলাপ হয় ক্যাথরিনের। ডেভিডও ছিলেন ক্যাথরিনের বাবার মতো পানাসক্ত। সব সময়ই তিনি মারপিটে জড়িয়ে পড়তেন। মনে মনে এ রকম এক জনকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে খুঁজছিলেন ক্যাথরিন।
ডেভিড এবং ক্যাথরিন একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। ডেভিডকে মেয়ের রণচণ্ডী রূপ সম্পর্কে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন মা বারবারা। ১৯৭৪ সালে, ডেভিডকে বিয়ে করেন ক্যাথরিন। তবে বিয়ের পর দিনই ডেভিডকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন ক্যাথরিন।
বিয়ের পরের রাতে ক্যাথরিন এবং ডেভিড তিন বার যৌনসঙ্গম করেন। এর পর ডেভিড হাঁফিয়ে যান। কিন্তু ক্যাথরিন তাঁকে আরও এক বার যৌনসঙ্গম করার জন্য জোর করতে থাকেন। ডেভিড ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ক্যাথরিন তাঁকে গলা টিপে খুন করার চেষ্টা করেন। ডেভিডের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তিনি ক্যাথরিনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন। এর পরও সেই সম্পর্ক ১২ বছর চলেছিল।
এর মধ্যেই ডেভিড একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যেই একটি সম্পর্কের কথা জানতে পেরে রেগে গিয়ে নিজের দু’ মাসের কন্যাসন্তানকে ট্রেন লাইনে ফেলে দিয়ে আসেন ক্যাথরিন। কোনওক্রমে রক্ষা পেয়েছিল ওই শিশু। নিজের আরও এক সন্তানকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন ক্যাথরিন।
ক্যাথরিনকে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু সেখান থেকে ছাড়া পেয়েও তাঁর চরিত্রের বদল হয়নি। মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে ফেরার পর পরই এক গাড়ি মেকানিককে খুন করার চেষ্টা করেন ক্যাথরিন। ক্যাথরিনের মেজাজ সামলাতে না পেরে ডেভিড বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
১৯৮৬ সালে ডেভিডের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরপরই ক্যাথরিন স্থানীয় খনি শ্রমিক ডেভিড সন্ডার্সের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
কয়েক মাসের মধ্যে, ক্যাথরিন এবং তাঁর দুই মেয়েকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন সন্ডার্স। কিন্তু সন্ডার্সকেও সব সময় সন্দেহের চোখে দেখতেন ক্যাথরিন। দ্রুত তাঁদের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ে। একে অপরকে মারধরও বাড়তে থাকে।
এক দিন সন্ডার্সের সামনেই তাঁর পোষা কুকুর ডিঙ্গোর গলা কেটে খুন করেন ক্যাথরিন। এর পর থেকে ক্যাথরিনকে রীতিমতো ভয় পেতে শুরু করেন সন্ডার্স। আরও এক বছর একসঙ্গে থাকেন যুগল। এক কন্যাসন্তানেরও জন্ম দেন ক্যাথরিন। মেয়ের জন্মের পর পরই এক দিন ঝামেলার সময় সন্ডার্সকে কাঁচি দিয়ে খুন করার চেষ্টা করেন ক্যাথরিন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সন্ডার্স বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান।
এর পর জন চিলিংওয়ার্থ নামে এক জনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ক্যাথরিন। তাঁরা একসঙ্গে ৩ বছর ছিলেন এবং সেই সময় ক্যাথরিন প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ক্যাথরিন এবং জনের সম্পর্ক ভালই ছিল। এর পর চার্লস থমাস প্রাইস নামে এক খনি শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ক্যাথরিন। আস্তে আস্তে ক্যাথরিনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন জন।
অন্য দিকে ক্যাথরিন এবং চার্লসের প্রেম জমে উঠেছিল। চার্লসের দুই ছেলেও ক্যাথরিনকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। ক্যাথরিন এবং তাঁর সন্তানদের নিজের বাড়িতে নিয়ে যান চার্লস। কয়েক মাসের মধ্যেই চার্লসকে বিয়ের প্রস্তাব দেন ক্যাথরিন। কিন্তু চার্লস রাজি না হওয়ায় ক্যাথরিন আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন।
রেগে গিয়ে চার্লসের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনেন ক্যাথরিন। এর ফলে চার্লসকে চাকরি থেকে বরখাস্তও করা হয়। রেগে গিয়ে ক্যাথরিনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন চার্লস। কিন্তু কয়েক মাস পর তাঁরা আবার মেলামেশা শুরু করেন। তবে ক্যাথরিনকে আর ঘরে আনেননি চার্লস।
২০০০-এর ফেব্রুয়ারিতে এক দিন রাতে চার্লসের সঙ্গে ঝামেলার পর তাঁকে খুন করার চেষ্টা করেন ক্যাথরিন। ক্যাথরিন তাঁর ছেলেদেরও খুন করতে পারে ভেবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন চার্লস। বন্ধুদের আগে থেকেই জানিয়ে রাখেন যে, কোনও দিন তিনি বা তাঁর দুই ছেলে যদি নিখোঁজ হন, তা হলে বুঝে নিতে যে ক্যাথরিন তাঁদের খুন করেছেন।
চার্লসের আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল। ২০০০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি চার্লস অফিস থেকে কাজ করে বাড়ি ফেরেন। ক্যাথরিনও তখন চার্লসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। রাতের খাবার খেয়ে এবং টিভি দেখে রাত ১১টা নাগাদ তাঁরা ঘুমোতে যান। সঙ্গমও করেন তাঁরা।
চার্লস ঘুমিয়ে পড়তেই ক্যাথরিন বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘর থেকে একটি মাংস কাটার ছুরি নিয়ে আসেন। সেই ছুরি দিয়ে ৩৭ বার কোপ মারা হয় চার্লসের বুকে। চার্লস প্রথম আঘাতের পর জেগে উঠলেও প্রাণ বাঁচাতে পারেননি।
চার্লসকে খুনের পর দেহ টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যান ক্যাথরিন। মৃতদেহের শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে তা মাংস ঝুলিয়ে রাখার হুকে আটকে দেন। দেহ থেকে মুন্ডু কেটে নিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয় বাকি দেহাংশ। শুধু তা-ই নয়, শরীরের টুকরোগুলি আলু, কুমড়ো, পেঁয়াজ, বিট, বাঁধাকপি, স্কোয়াশের সঙ্গে রান্না করে একটি স্যুপ তৈরি করেন। তৃপ্তি করে সেই স্যুপের অনেকটা খেয়েও ফেলেন ক্যাথরিন। ওষুধ খেয়ে বাকি দেহাবশেষের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েন।
চার্লস কাজে আসা বন্ধ করার কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর সহকর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ক্যাথরিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে ক্যাথরিনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। পুলিশ আদালতে জানায়, চার্লসের শরীরের অঙ্গগুলি তাঁর সন্তানদেরও রান্না করে খাওয়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন ক্যাথরিন। খুন করার নৃশংসতা হতবাক করেছিল বিচারককে।
বিচারক শুনানি শেষে রায় দেন, ক্যাথরিনকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যেন এক দিনের জন্যও জেলের বাইরে বেরোতে না দেওয়া হয়। তার পর থেকে তিনি ‘সিলভারওয়াটার উইমেনস’ সংশোধনাগারে বন্দি। বর্তমানে তাঁর বয়স ৬৭।