শ্রীলঙ্কার অর্থভান্ডারে টান পড়েছিল আগেই। ২০২২ সালে সেই টলমল অর্থনীতির প্রভাব পড়তে শুরু করে দেশের রাজনীতিতেও। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-সহ দেশের প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন মানুষ। যা রাষ্ট্রপ্রধানের গদি নড়িয়ে দেয়।
২০২২ সালে প্রবল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে ঠেকেছিল। হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম।
আর্থিক বিপর্যয়ে ক্লান্ত সেই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামলে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ফের মাথা তুলছে ভারত মহাসাগরের এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে শ্রীলঙ্কায় যে হারে মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা এখন অনেকটাই কমেছে। টাকার দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা কি এখন পুরোপুরি ‘সঙ্কটমুক্ত’?
আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের (আইএমএফ) কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে অর্থনীতির হাল ধরেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু তাতে সঙ্কট পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি।
সম্প্রতি আইএমএফের কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলারের অর্থসাহায্য পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। তাতেই দেশের মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে তৈরি হয়েছে নতুন সঙ্কট।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতির হার পৌঁছে গিয়েছিল ৬৯ শতাংশে। তা কমতে কমতে ১২ শতাংশে পৌঁছয় গত জুন মাসে। তার পর মুদ্রাস্ফীতির হার আরও খানিকটা কমেছে।
গত কয়েক মাসে শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ৬.৩ শতাংশ। এর ফলে সার্বিক ভাবে জিনিসপত্রের দাম কমেছে। কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন দেশের মানুষ।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে নতুন জটিলতা লক্ষ্য করছেন বিশেষজ্ঞেরা। জল, খাবার, বিদ্যুতের মতো আবশ্যিক উপাদানগুলির মূল্য এখনও তাদের চিন্তার কারণ। এগুলিই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিবন্ধক।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কায় রাষ্টায়ত্ত সংস্থাগুলিকে এখনও ঠিক ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে অর্থনৈতিক সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করা যায়নি এখনও।
আইএমএফের তরফে অর্থনীতির যে নিয়মকানুন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি সেই নিয়ম মানছে না বলেও দাবি। যাকে অর্থনৈতিক জটিলতার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এই সমস্যার কারণে আগামী দিনে আবার মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। মুদ্রার অবনমন এবং খাদ্যের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি বছরের শেষে শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি ৬ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে থিতু হতে পারে।
চলতি বছরে শ্রীলঙ্কার মুদ্রার মান ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা তাতে চিন্তামুক্ত নন। কারণ শ্রীলঙ্কা আদ্যোপান্ত আমদানি নির্ভর দেশ। আমদানির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা তাঁদের।
শ্রীলঙ্কার কয়েকটি অংশে চলতি বছরে খরার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে ধান চাষের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া, জলের উপর ৫০ শতাংশ কর চাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। এই বিষয়গুলি অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অবশ্য অর্থনীতির স্থিতিশীলতার বিষয়ে আশাবাদী। তারা জানিয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্যমাত্রা তাদের সামনে রয়েছে, তা ৪ থেকে ৬ শতাংশ। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলবে বলে আশাবাদী তারা।
চলতি বছরের শেষ ভাগে সুদের হার কিছুটা হ্রাস করার ভাবনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের। অর্থনীতির সাম্প্রতিক জটিলতা থেকে শ্রীলঙ্কা বেরিয়ে আসতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।