পূর্ব এশিয়ার গুটিকয়েক দেশে কমছে জনসংখ্যা। সেই দেশগুলির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিয়ে না করার এবং সন্তানের জন্ম না দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গড় জন্মহারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে নবজাতকের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে যে সব দেশের, তাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া।
সেখানকার জনসংখ্যার পরিমাণ এতই কমে গিয়েছে যে, কোনও যুদ্ধবিগ্রহ বা পড়শি দেশের বোমার প্রয়োজন পড়বে না। জন্মহার হ্রাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এক দিন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার অস্তিত্বই মুছে যাবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলিতে জন্মের হার কমতে দেখা গিয়েছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চরম সঙ্কটের মুখোমুখি তেমন কেউই নয়। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া দ্বাদশ স্থানে রয়েছে। এশিয়ায় চতুর্থ। বিত্তশালীই বলা যায় এই দেশটিকে। তা হলে কেন এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হল দক্ষিণ কোরিয়ায়?
অতিমারি পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। বেড়েছে পরিবার ছোট রাখার প্রবণতা। এমনকি, সেখানকার তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ এখন বিয়ে করতেই রাজি নন। এরই জেরে দ্রুতহারে কমছে জন্মহার।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশটির জন্মহার এতটাই নেমে গিয়েছে যে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, শতাব্দীর শেষ নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা তার বর্তমানের তুলনায় এক তৃতীয়াংশে সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে।
সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ানে’র একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো জনসংখ্যা কমতে শুরু করে ২০২০ সালে।
২০২৪ সালের একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে একটি বিস্ফোরক তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মহিলা বিয়েই করতে চান না। তার কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে এক বিস্ময়কর তথ্য।
বিবাহে অনিচ্ছুক মহিলাদের ৯৩ শতাংশই চান না তাঁদের ঘাড়ে গৃহকর্মের বোঝা এসে পড়ুক। সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব তরুণ-তরুণীদের বিয়ে না করার অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়েছে।
জনসংখ্যা হ্রাসের এই সমস্যার মূলে রয়েছে দেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের তরুণীরা পরিবার পরিকল্পনার চেয়ে নিজের পেশাকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছেন। ২০২৩ সালের একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সন্তান লালনপালনকে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে উল্লেখ করেছেন চাকুরিরতা মহিলারা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় লিঙ্গ বিভাজনও জনসংখ্যা-সঙ্কটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে সেখানকার অল্পবয়সি পুরুষদের মধ্যে নারীবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল ২০২২ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর লিঙ্গভিত্তিক সংরক্ষণ বাতিল করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির মূল কারণ নারীবাদ, এমন মতও পোষণ করতে দেখা গিয়েছে ইওলকে।
লিঙ্গ সমতার বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান সর্বনিম্ন, বিশ্বব্যাপী ৯৪তম স্থানে রয়েছে দেশটি। এ দেশের বিবাহিতা মহিলারা পরিবারের দায়িত্বে আরও সমতা দাবি করছেন। পারিবারিক কাজ ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বিশাল ফারাক লক্ষ করা গিয়েছে।
২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মোট প্রজননের হার (এক জন মহিলার প্রজনন বয়সে গড় সন্তানের সংখ্যা) দাঁড়িয়েছে ০.৭২। ২০২২ সালে এই গড় ছিল ০.৮১। একটি দেশের সুস্থ ও স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য এই গড়ের প্রয়োজনীয় মান হল ২.১। সেই মানের তুলনায় বর্তমান হার অনেকটাই নীচে।
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে গড় শিশু জন্মহার ১.৬ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যাকে একই আকারে রাখার জন্য প্রতি দম্পতির কমপক্ষে দু’টি সন্তানের প্রয়োজন।
৭০-এর দশকের শুরুতে দেশটিতে নারীদের গড়ে চারটি সন্তান থাকত। ১৯৬০ সালে এই হার ছিল ৬। সেই সময় দেশের অর্থনীতির হাল ধরতে সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা শুরু করে। ১৯৮২ সাল নাগাদ অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রজনন হার ২.৪ এ স্থির হয়ে যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৮ শতাংশ কমে গিয়েছে। কমতে কমতে এখন জন্মহার এসে দাঁড়িয়েছে ০.৭ শতাংশে, যা সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
সংবাদমাধ্যম ইকনমিক টাইমসের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে হারে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে তা খুবই উদ্বেগের। এর ফলে ২১০০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা ৫ কোটি ২ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৭০ লক্ষে এসে দাঁড়াবে।
একই ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় বেড়েছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। দেশটিতে ৬০ বা তার বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা এখন মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ। গড় আয়ুর উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির কারণে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে, সন্তানধারণে অনিচ্ছার কারণে কমছে পরিবারের সংখ্যাও।
এমন চলতে থাকলে দেশে সামাজিক কাঠামোই নষ্ট হয়ে যাবে, ভেঙে পড়বে অর্থনীতি। এমনটাই আশঙ্কা সে দেশের সরকারের। তাই বিয়ে ও সন্তানধারণের প্রতি যুব সমাজকে আকৃষ্ট করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে ইওল সরকার।
সন্তান থাকলে কর সংক্রান্ত সুবিধা প্রদান করা, এমনকি ৩০ বছর বয়সের মধ্যে যদি তিন বা তার বেশি সন্তান থাকে তবে পুরুষদের বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও তাতে খুব একটা ছাপ পড়েনি কোরিয়ার জনমানসে।