এক শতকেরও বেশি আগে অতলান্তিকের গভীরে হারিয়ে গিয়েছিল ‘এনডিওরেন্স’। অ্যাংলো-আইরিশ অভিযাত্রী স্যর আর্নেস্ট শেকেলটনের কাঠের জাহাজ।
সম্প্রতি সেই কাঠের জাহাজটি খুঁজে পেয়েছে ‘এনডিওরেন্স ২২’ নামের এক অভিযাত্রী দল। ৫ মার্চ জাহাজটি খুঁজে পান তাঁরা।
তবে ১০৭ বছর ধরে জলের তলায় থাকলেও আশ্চর্যজনক ভাবে প্রায় অক্ষত রয়েছে জাহাজটি। এমনকি, তার গায়ে ‘এনডিওরেন্স’ লেখা নামটিও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্যর শেকেলটনের জাহাজটির খোঁজে রওনা দিয়েছিল ‘এনডিওরেন্স ২২’। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ওই অভিযাত্রী দলের। ঘটনাচক্রে, জানুয়ারিতেই স্যর শেকেলটনের মৃত্যুর শতবার্ষিকী পালিত হয়ে গিয়েছে।
১৯১৫ সালে প্রথম বার অ্যান্টার্কটিকা পার করার উদ্দেশ্যে ‘এনডিওরেন্স’ নিয়ে লন্ডন থেকে রওনা হয়েছিলেন স্যর শেকেলটন। সঙ্গে ছিলেন ২৮ জন জাহাজকর্মী। ১৪৪ ফুট লম্বা ওই জাহাজে ছিল ৬৯টি কুকুর এবং একটি বেড়াল— মিসেস চিপি।
তবে লক্ষ্যপূরণ করতে পারেনি স্যর শেকেলটনের ‘এনডিওরেন্স’। অ্যান্টার্কটিকার ভাহসেল বে-তে পৌঁছনোর আগেই ওয়েডেল সি-র বরফের মাঝে আটকে পড়েছিল জাহাজটি। সেটি ছিল ১৯১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। অক্টোবর মাস আসতেই তাপমাত্রা কমতে থাকে। শেষমেশ বরফের চাপে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যায় ‘এনডিওরেন্স’। সে বছরের ২১ নভেম্বর ডুবে যায় জাহাজটি।
সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়ার আগে জাহাজে ছিলেন কর্মীরা। এমনকি, বরফের চাঁইয়ের মাঝে বেশ কয়েক মাস তাঁবু খাটিয়েও ছিলেন তাঁরা। এর পর বোটে চেপে এলিফ্যান্ট দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেন। অনেকের দাবি, বেঁচে থাকার জন্য জাহাজের কুকুরছানাদের কেটে তার মাংস খেয়েছিলেন কর্মীরা।
মানুষের বসবাসের অযোগ্য এলিফ্যান্ট দ্বীপে জাহাজকর্মীরা থেকে গেলেও একটি খোলা বোট নিয়ে আরও এক দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু করেন স্যর শেকেলটন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পাঁচ জন জাহাজকর্মী। ১,৩০০ কিলোমিটারের যাত্রা শেষে তাঁরা পৌঁছন অতলান্তিকের দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে।
এক সময় দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপ পার করে স্টর্মনেস শহরে পৌঁছন স্যর শেকেলটন এবং তাঁর দুই সঙ্গী। এর পর চিলির নৌসেনা বাহিনীর থেকে একটি বোট ধার নেন তাঁরা। ১৯১৬ সালের ৩০ অগস্টে সেটির সাহায্যেই নিজের বাকি সঙ্গীদেরও উদ্ধার করেন স্যর শেকেলটন।
সমুদ্রের গভীরে কোথায় হারিয়ে যেতে পারে ‘এনডিওরেন্স’? হিসাব কষে তা রেকর্ড করে রেখেছিলেন ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন ফ্যাঙ্ক ওর্সলি। সে হিসাবও প্রায় মিলে গিয়েছে। ওর্সলির মাপাজোক কষা পয়েন্টের থেকে প্রায় ৪ মাইল দূরে ‘এনডিওরেন্স’-কে খুঁজে পেয়েছে ‘এনডিওরেন্স ২২’-এর অভিযাত্রী দলটি।
এক শতক ধরে সমুদ্রের নীচে থাকলেও কী ভাবে প্রায় অক্ষত থাকল ‘এনডিওরেন্স’? ন্যাচারাল হিস্টি মিউজিয়ামের জীববিজ্ঞানী অ্যাড্রিয়ান গ্লোভার অবশ্য এতে একেবারেই অবাক নন। ২০১৩ সালে একটি গবেষণাপত্রে তাঁর ভবিষ্যৎবাণী ছিল, ‘এনডিওরেন্স’ প্রায় অক্ষত থাকবে।
অ্যান্টার্কটিকায় চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান কারেন্টের জেরেই কাঠের জাহাজে শ্যাওলা জমতে পারেনি বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। ফলে জাহাজের গায়ে লার্ভা বা অন্যান্য সামুদ্রিক প্রজাতির উপদ্রব করতে পারেনি।
অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্রে গেঁড়ি-গুগলির মতো প্রজাতির শামুকের দেখা মেলে না। যেগুলি জাহাজের কাঠে ক্ষয় ধরাতে সক্ষম। ফলে এনডিওরেন্স যে অক্ষত রয়েছে, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয় বলে মনে করেন গ্লোভার।
লন্ডনের ফকল্যান্ড মেরিটাইম হেরিটেজ ট্রাস্ট জানিয়েছে, অ্যান্টার্কটিক চুক্তি অনুযায়ী এই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এবং ওই জায়গাটিকে আগেই ঐতিহাসিক স্থল ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে উৎসাহীরা ওই স্থলে পৌঁছে ধ্বংসাবশেষ ক্যামেরাবন্দি করার অনুমতি পেলেও জাহাজটি স্পর্শ করতে পারেন না।
স্যর শেকেলটনের জাহাজের খোঁজে বেরিয়েছিল ‘এস এ অগালহাস-২’ নামে একটি জাহাজ। এক সময় ‘এনডিওরেন্সে’র মতোই ওই একই জায়গায় বরফের ফাঁদে আটকা পড়ে সেটি। সে সময় তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে মেকানিক্যাল ক্রেন-সহ নানা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় বরফের ফাঁদ কাটিয়ে ওঠেন জাহাজকর্মীরা। ফলে ‘এনডিওরেন্সে’র পরিণতি এড়াতে পেরেছিলেন তাঁরা।