জার্মানির বাভারিয়া স্টেটের ছোট্ট শহর হার্জ়োজেনরাখ। অরাখ নদীর তীরে সেই সুন্দর শহরে জন্ম দুই ডাসলার ভাইয়ের। রুডলফ আর অ্যাডলফ। তাঁদের দুই ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই জন্ম দিয়েছিল বিখ্যাত দুই জুতোর ব্র্যান্ড পুমা আর অ্যাডিডাসের। তার পর বদলে গিয়েছিল ক্রীড়াপণ্যের জগৎ।
১৮৯৮ সালে জন্ম বড় ভাই রুডলফের। দু’বছর পর ১৯০০ সালে জন্ম অ্যাডলফের। বন্ধুমহলে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘অ্যাডি’ নামে। তাঁদের বাবা কাজ করতেন জুতোর কারখানায়।
অনেকেই মনে করেন, বাবাকে দেখেই জুতো তৈরির পেশাকে বেছে নেন দুই ভাই। যদিও বাবা চেয়েছিলেন, বড় ছেলে রুডলফ হোক পুলিশ। আর ছোট ছেলে অ্যাডলফ হোক কেক নির্মাতা।
যদিও অ্যাডির স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। তিনি অ্যাথলিট হতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তার পর বুঝেছিলেন, খেলোয়াড়দের পরার মতো উপযুক্ত জুতোই তৈরি করে না সংস্থাগুলো। ঠিকঠাক জুতো তৈরি হলে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স অনেক ভাল হবে।
এর পরই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অ্যাডিকে যুদ্ধে পাঠায় জার্মান সরকার। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে মায়ের শৌচালয়ে জুতো তৈরির কারখানা শুরু করে তিনি। সহায়তা করেন জুতো প্রস্তুতকারী কার্ল জ়েক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয় জার্মানিতে। ঘরে ঘরে তখন দারিদ্রের থাবা। জুতোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কেনারও ক্ষমতা ছিল না অ্যাডির।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া হেলমেট, জল ভরার থলির চামড়া দিয়ে জুতো তৈরি করা শুরু করেন অ্যাডি। পরিত্যক্ত প্যারাস্যুটের কাপড় দিয়ে তৈরি করতেন চটি।
জুতো তৈরির জন্য যে যন্ত্র চালাবেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎও ছিল না বাড়িতে। সাইকেলের সঙ্গে যন্ত্রের সংযোগ করেছিলেন অ্যাডি। সাইকেলে প্যাডেল করে উৎপন্ন করতেন বিদ্যুৎ। সেই দিয়ে চলত জুতো তৈরির যন্ত্র।
দু’বছর পর অ্যাডির কারখানায় যোগ দেন দাদা রুডলফ। দু’জনে মিলে তৈরি করেন জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থা জেব্রুডার ডাসলার স্কুহফাব্রিক। অ্যাডি জুতো তৈরির বিষয়টি দেখতেন। আর রুডলফ দেখাশোনা করতেন সেলস এবং মার্কেটিংয়ের দিকটি।
১৯২৫ সাল নাগাদ চামড়ার তৈরি ফুটবল খেলার বিশেষ বুট তৈরি করেন অ্যাডি, যার নীচে পেরেকের মতো (নেল স্টাড) বসানো ছিল। ট্র্যাকে দৌড়নোর জন্যও জুতো তৈরি করে অ্যাডির সংস্থা। ওই বিশেষ জুতোর নীচে বসানো থাকত স্পাইক।
ধীরে ধীরে প্রচুর কর্মী নিয়োগ করে অ্যাডিদের সংস্থা। দিনে ৫০ জোড়া জুতো তৈরি করতে শুরু করেন তাঁর। ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিক্সে অ্যাডির সংস্থার তৈরি জুতো পরে দৌড়ে সফল হন লিনা রাডকে। ৮০০ মিটার দৌড়ে সোনা জেতেন তিনি। নতুন রেকর্ডও গড়েন।
লিনার জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাডির তত্ত্ব হাতেনাতে প্রমাণিত হয়— উপযুক্ত জুতো পরলে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ভাল হতে বাধ্য। ১৯৩২ সালের লস অ্যাঞ্জেলস এবং ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক্সে প্রতিযোগীদের প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠে অ্যাডির সংস্থার জুতো।
১৯৩৬ সালে আমেরিকার ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড তারকা জেস ওয়েন্স চারটি সোনার পদক জয় করেন। তিনিও পরেছিলেন অ্যাডির সংস্থার তৈরি জুতো। তার পরেই জেব্রুডার ডাসলার স্কুহফাব্রিক সংস্থার জুতো বিক্রি হুড়মুড়িয়ে বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রুডলফ যুদ্ধে যেতে বাধ্য হন। জুতোর ব্যবসা তখন একাহাতে সামলেছিলেন অ্যাডি। চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও জুতো তৈরি বন্ধ করেননি অ্যাডি। ১৯৪৩ সালে জার্মানির প্রায় সমস্ত কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখনও খেলোয়াড়দের জন্য জুতো তৈরি করছিল অ্যাডির সংস্থা। যদিও ১৯৪৪ এবং ১৯৪৫ সালে সেই কারখানাও উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
এত দিন পর্যন্ত স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে একই বাড়িতে বাস করতেন রুডলফ এবং অ্যাডি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় লাগাতার বোমা পড়ছিল হার্জ়োজেনরাখ শহরে। পরিবার নিয়ে শিবিরে আশ্রয় নেন অ্যাডি। রুডলফের পরিবার আগে থেকেই ছিল ওই শিবিরে।
জনশ্রুতি, শিবিরে ঢুকে অ্যাডি নাকি বলেছিলেন, ‘‘আবার ফিরে এল নোংরা ...’’। অ্যাডি যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন। রুডলফের ধারণা হয়, তাঁর পরিবারের উদ্দেশেই এ সব বলেছিলেন ছোট ভাই। এর পরেই ভিন্ন হয় হাঁড়ি, ব্যবসাও।
জেব্রুডার ডাসলার স্কুহফাব্রিক সংস্থা ভেঙে নিজের নামে ‘অ্যাডিডাস’ তৈরি করেন অ্যাডি। আর রুডলফ নিজের সংস্থার নাম দেন ‘রুডা’। পরে ক্রমে তা হয় ‘পুমা’।
সংস্থার কিছু কর্মী যোগ দেন পুমায়। কিছু অ্যাডিডাসে। কারখানার পাশাপাশি ছোট্ট শহরটিকেও ভেঙে নেন দুই ভাই। নদীর এ পারে এক জন, ও পারে এক জন। দুই কারখানাকে কেন্দ্র করে নদীর দুই পাশে গড়ে ওঠে পানশালা, বেকারি, খেলার ক্লাব। এক সংস্থার অর্থাৎ এক পারের লোকজন অন্য দিকে যেতেন না।
এক সংস্থার কর্মীরা অন্য সংস্থার নাম মুখেও আনতে পারতেন না। এমনই ছিল নির্দেশ। দুই ভাইয়ের ঝামেলা গড়িয়েছিল কবর পর্যন্ত। রুডলফ আর অ্যাডি, দু’জনেই বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যেন পাশাপাশি কবর দেওয়া না হয় তাঁদের। সেই মতো একই কবরস্থানে দু’জনকেই কবর দেওয়া হলেও মাঝে ছিল বিস্তর দূরত্ব।
১৯৮৭ সালে অ্যাডলফের ছেলে হর্স্ট ডাসলার অ্যাডিডাস বিক্রি করেন ফরাসি শিল্প বার্নার্ড টাপিকে। পুমার ৭২ শতাংশ শেয়ার এক সুইস সংস্থাকে বিক্রি করে দেন রুডলফের ছেলে আরমিন এবং জার্ড। এর পর থেকে দুই সংস্থার মালিকানা আর দুই পরিবারের হাতে নেই।