পরনে জিন্স, টপ। চালচলনেও আধুনিক ছোঁয়া। ইনদওরের এমজিএম মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্টিনে ইতিউতি ঘোরাফেরা করছিলেন ২৪ বছরের শালিনী।
শালিনীর সঙ্গে যে ব্যাগ ছিল, তাতে ঠাসা বইখাতা। ক্লাসের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই ক্যান্টিনে চলে আসতেন তিনি। বাকিদের সঙ্গে যেচে আলাপ করতেন, আড্ডা জমে যেত।
কেউ ঘূণাক্ষরেও টের পাননি, সুবেশা এই তরুণী আদৌ মেডিক্যাল কলেজের কেউ নন। কলেজ তো দূর, চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে দূরদূরান্ত পর্যন্ত তাঁর কোনও সংস্পর্শই নেই।
এমজিএম মেডিক্যাল কলেজে মাস তিনেক ছদ্মবেশে কাটিয়েছেন শালিনী চৌবে। পেশাগত ভাবে তিনি পুলিশ। সংযোগিতাগঞ্জ থানায় কর্মরত শালিনীর উপর ভার ছিল সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মামলার রহস্য সমাধানের। সেই সূত্রেই ডাক্তারি কলেজে যাতায়াত বাণিজ্যের ছাত্রী শালিনীর।
এমজিএম মেডিক্যাল কলেজে গত জুলাই মাসে এমবিবিএস-এর প্রথম বর্ষের একদল ছাত্রকে র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। কারা সেই র্যাগিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পুলিশ কিছুতেই শনাক্ত করতে পারছিল না।
সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইন চার্জ বলেন, ‘‘মামলাটি বন্ধ করে দিতে হয় প্রমাণের অভাবে। আমাদের কাছে কোনও সূত্র, কোনও তথ্য ছিল না। তাই আমরা একটু অন্য ভাবে এই রহস্যের সমাধান করতে উদ্যোগী হয়েছিলাম।’’
সদ্য পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন শালিনী। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বড় কাজ। সেই প্রথম পরীক্ষায় লেটার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হন শালিনী। তাঁর এই কীর্তি সিনেমার গল্পকেও হার মানাচ্ছে।
এমজিএম কলেজে র্যাগিংয়ের ঘটনার তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন থানার অফিসার ইন চার্জ তেহজ়িব কাজ়ি এবং সত্যজিৎ চৌহান। তাঁরাই শালিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সবসময়। কোন কোন ছাত্রের উপর নজর রাখতে হবে, শালিনীকে আগে থেকে বলে দিয়েছিলেন তাঁরা।
ক্যান্টিনে ঘুরতে ঘুরতে সকলের সঙ্গে গল্প করে ছাত্রছাত্রীদের অনেক গোপন কথাও সুকৌশলে জেনে নিতেন শালিনী। কেউ তাঁকে পুলিশ বা গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করেনি কখনও।
শালিনী জানিয়েছেন, এই কাজে তাঁকে প্রায়ই নানা মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। কখনও কখনও তাৎক্ষণিক দক্ষতায় বানিয়ে ফেলতে হয়েছে খুচরো গল্প। উপস্থিত বুদ্ধির জোরে নিজের পরিচয় লুকিয়ে সফল হয়েছেন শালিনী। নিজেই জানিয়েছেন, কাজটা সহজ ছিল না একেবারেই।
পুলিশের ঘর থেকেই পুলিশ হয়েছেন শালিনী। তাঁর বাবাও পুলিশে চাকরি করতেন। ২০১০ সালে তিনি মারা যান। তার এক বছরের মধ্যে মাকেও হারান শালিনী। বাবার থেকেই এই পেশায় আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তিনি।
অবশ্য শালিনী একা নন, পুলিশের একটি আস্ত দল র্যাগিং রহস্যের সমাধানের জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল। কলেজের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়িয়ে, পড়ুয়াদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।
তদন্তকারী অফিসার সত্যজিৎ বলেন, ‘‘এই কাজটার জন্য আমরা শালিনীকেই বেছে নিয়েছিলাম কারণ ওঁকেই সবচেয়ে পড়ুয়াসুলভ বলে মনে হয়। কলেজছাত্রীর মতোই ওঁকে দেখতে লাগে। তাই পড়ুয়ারা ওঁকে সহজে বিশ্বাস করেছে।’’
কলেজের মোট ১১ জন ছাত্রকে চিহ্নিত করেছেন শালিনী। তিনি বলেন, ‘‘আমি বসে বসে শুধু এই ১১জনকে দেখতাম। ওঁদের আচরণ ঔদ্ধত্যপূর্ণ। নিজেদের মধ্যে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে তাঁরা র্যাগিং করতেন।’’
র্যাগিংয়ের সময় ডাক্তারি পড়তে আসা ছাত্রদের দিয়ে উচ্চবর্ষের পড়ুয়ারা নানা রকম আপত্তিকর কাজ করিয়ে নিতেন বলে অভিযোগ। পুলিশ জানিয়েছে, ছদ্মবেশে অপরাধীদের শনাক্ত করতে না নামলে এই মামলার কোনও সুরাহা করা যেত না।
যে ১১ ছাত্রকে র্যাগিংয়ে অভিযুক্ত হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে এক জন বাংলার ছাত্র। বাকি ৯ জন রয়েছেন মধ্যপ্রদেশের এবং ১ জন রয়েছেন বিহারের। তাঁদের থানায় ডেকে পাঠানো হয়। প্রত্যেককে নোটিস ধরানো হয়েছে।
অভিযুক্তদের প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের। ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদের পর আরও তথ্য প্রকাশ্যে আসবে বলে আশাবাদী পুলিশ।