দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটা মাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ পৃথিবীর। সেই চাঁদও কিনা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে! পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে উপগ্রহটি। তেমনটাই দাবি বিজ্ঞানীদের।
পৃথিবী এবং মহাকাশের বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ এবং খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা চাঁদের এই সরণ সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, বছরে পৃথিবীর সঙ্গে ৩.৮ সেন্টিমিটার করে দূরত্ব বৃদ্ধি করছে চাঁদ। নাসার প্যানেলের মাধ্যমে সেই তথ্য পৃথিবীর গবেষকেরা জানতে পেরেছেন।
১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো অভিযানে চাঁদে যখন মহাকাশচারী পাঠিয়েছিল নাসা, সেই সময়েই চাঁদের মাটিতে তারা প্রতিফলক প্যানেল বসিয়ে রেখেছিল। তাতেই ধরা পড়েছে বছর বছর চাঁদের সরণ।
কিন্তু কেন সরছে চাঁদ? কেনই বা তা নিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাচ্ছেন? চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পেলে ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে?
বিজ্ঞানীদের অনুমান, চাঁদ যে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি করছে, তার নেপথ্য রয়েছে পৃথিবীর মিলানকোভিচ চক্র। পৃথিবীতে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক কোনও পরিবর্তনের জন্যও এই চক্রকে দায়ী করা হয়।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, পৃথিবীর কক্ষপথ এবং অক্ষের অবস্থানে মাঝেমধ্যে কিছু তারতম্য হয়। যার প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে সূর্যরশ্মির বিকিরণের উপরেও।
পৃথিবীর কোন অংশে কতটা সূর্যের আলো পড়ছে, সেই হিসাবে সামান্য বিচ্যুতিও আবহাওয়ার বড়সড় পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে। মিলানকোভিচ চক্রের কারণেই এমনটা হয়ে থাকে।
সাহারা মরুভূমিতে গাছপালার জন্ম কিংবা প্রাচীন কালে পৃথিবীর বুকে নেমে আসা হিমযুগ— আবহাওয়াজনিত নানা পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে এই মিলানকোভিচ চক্র। চাঁদের অবস্থানকেও তা প্রভাবিত করছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের।
পৃথিবীর মিলানকোভিচ চক্র প্রতি চার লক্ষ, এক লক্ষ, ৪১ হাজার এবং ২১ হাজার বছর অন্তর পরিবর্তিত হয়। এই সময়ের ব্যবধানের সঙ্গে চাঁদের দূরত্বের সরাসরি যোগ রয়েছে। কারণ, এই সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর কক্ষপথের আকার বদল হয়।
বর্তমানে মিলানকোভিচ চক্রের ২১ হাজার বছরের পর্ব চলছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই চক্রের পরিবর্তনের ব্যবধান আগে আরও কম ছিল। চাঁদের দূরত্বও পৃথিবী থেকে আগে আরও কম ছিল।
২৪৬ কোটি বছর আগে পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যে ব্যবধান ছিল বর্তমান ব্যবধানের চেয়ে ৬০ হাজার কিলোমিটার কম। অর্থাৎ, চাঁদ আরও ৬০ হাজার কিলোমিটার কাছে ছিল।
এই চক্রের কারণে পৃথিবীর দিনরাতের হিসাবেও হেরফের হয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চাঁদের দূরত্বের বিচারে ২৪৬ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য ২৪ ঘণ্টা ছিল না। বরং ১৭ ঘণ্টায় এক দিন হয়ে যেত।
চাঁদের গতিবিধি এবং পৃথিবীর কক্ষপথ, অক্ষের বিবর্তন স্পষ্ট করে বুঝতে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেই চেষ্টা চলছে।
পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন শিলার মধ্যেই চাঁদ এবং পৃথিবীর বিবর্তনের চিহ্ন লুকিয়ে আছে। সেই প্রাচীন পাথরখণ্ডের খোঁজ করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ধরনের শিলার খোঁজ মিলেছে। শিলার উপরে জমা পলির স্তর পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা মিলানকোভিচ চক্রের স্থায়িত্ব এবং তার ভিত্তিতে চাঁদের সরণ বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছেন।