আপাত দৃষ্টিতে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্কই বজায় রেখে চলে আমেরিকা। সেখানকার তেলের খনিতে আমেরিকার আধিপত্য কারও অজানা নয়।
কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে নাক গলিয়েছে চিন। তাদের কৌশলে এই এলাকার রাজনীতির পাশা উল্টে যেতে পারে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ সৌদি আরব। বিশ্বের খনিজ তেলের বাণিজ্য অনেকটাই নির্ভর করে তাদের উৎপাদন এবং বণ্টনের উপর। কিন্তু একই এলাকায় সৌদির ‘শত্রু’ হিসাবে রয়েছে আর এক দেশ। ইরান।
ইরান আর সৌদির মাঝে রয়েছে শুধু পারস্য উপসাগর। তেল থেকে শুরু করে আমেরিকার সান্নিধ্য, নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে অতীতে একাধিক বার ঝামেলায় জড়িয়েছে এই দুই প্রতিবেশী দেশ।
কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়ার এই দুই ‘চিরশত্রু’র মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সৌজন্যে চিন। তারাই আগ বাড়িয়ে সৌদি এবং ইরানের দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করেছে। নানা প্রতিশ্রুতি, প্রস্তাব দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি করিয়েছে দুই দেশের প্রধানকে।
সৌদি এবং ইরানের সম্পর্কের বরফ গলাতে বেজিংয়ের এই উপর্যুপরি তৎপরতা ভাল চোখে দেখেনি আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। সম্প্রতি, আমেরিকার সঙ্গে সৌদির সম্পর্কের অবনতির আরও কিছু কারণ প্রকাশ্যে এসেছে।
ওয়াশিংটন পোস্ট একটি রিপোর্টে দাবি করেছে, সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন নাকি আমেরিকাকে ‘হুমকি’ দিয়েছেন। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের নীতির উপর ‘খবরদারি’ করতে আমেরিকাকে অর্থনৈতিক ক্ষতি সইতে হতে পারে।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, সৌদি এবং আমেরিকার সম্পর্কে একটি গোপন নথি তাদের হাতে এসেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের সেই নথিতেই যুবরাজ সলমনের এই উক্তির উল্লেখ রয়েছে।
সৌদির যুবরাজ নাকি আরও বলেছিলেন, তিনি আমেরিকার প্রশাসনের সঙ্গে আর কোনও রকম চুক্তি করতে চান না। যদিও এই রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে সৌদি যে গত কয়েক বছরে চিনের দিকে ঝুঁকেছে, তা অনেকেরই নজর এড়ায়নি।
আমেরিকার সঙ্গে ইরানের বনিবনা নেই। চিনের মধ্যস্থতায় সেই ইরানের সঙ্গে সৌদির শান্তি চুক্তি স্থাপন আমেরিকার সঙ্গে তাদের দূরত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, চিনের সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় সৌদি। তারা চিনের থেকে ড্রোন এবং বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
সৌদি তাদের সামগ্রিক তেল উৎপাদনের পরিমাণে কিছুটা কাটছাঁট করেছিল। তার পর থেকেই আমেরিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন বাইডেন। যা ভাল চোখে দেখেনি পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ।
রিপোর্টে দাবি, চলতি বছরের জুলাই থেকে দিনে আরও ১০ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি। আমেরিকার বিরোধিতায় কর্ণপাতও করেনি তারা।
সৌদির এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সারা বিশ্বের তেলের ভান্ডারে টান পড়তে পারে। কারণ এই দেশেই রয়েছে পৃথিবীতে মজুত পেট্রোলিয়ামের প্রায় ১৭ শতাংশ। সৌদি উৎপাদন কমিয়ে দিলে ফল ভুগতে হতে পারে বহু দেশকে।
তেলের উৎপাদন কমে গেলে বিভিন্ন দেশে তার জোগানেও ঘাটতি হবে। এর ফলে পেট্রোল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে। যার প্রভাব পড়বে বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামেও।
ফলে আমেরিকার হাত ছেড়ে সৌদি চিনের দিকে ঝুঁকলে এবং তেল উৎপাদন কমিয়ে দিলে অদূর ভবিষ্যতে সারা বিশ্ব বড়সড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হতে পারে। তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত বছর থেকেই সৌদির কাছে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার অনুরোধ জানাচ্ছে আমেরিকা। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশে পেট্রোপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। ভারতেও যার প্রভাব দেখা গিয়েছে।
যদিও ওয়াশিংটন পোস্টকে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জানিয়েছে, সৌদির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে। সম্পর্কে কোনও অবনতির কথা স্বীকার করেনি ওয়াশিংটন।
আমেরিকার প্রশাসন সৌদির যুবরাজের কোনও হুমকির কথাও স্বীকার করেনি। বরং তাদের বক্তব্য, পশ্চিম এশিয়ায় সৌদি আরব আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘মিত্র’ দেশ। তারা এক সঙ্গে মিলেই ওই এলাকা এবং সমগ্র বিশ্বের উন্নতির কাজে অগ্রসর হবে।
আমেরিকার আরও দাবি, চিনের সঙ্গে সৌদির ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে রং চড়িয়ে নানা রকম গুজব রটানো হচ্ছে। এ সব কিছুই তেমন ফলপ্রসূ হবে না।