ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধায়কদের বেতনে বিস্তর ফারাক। শুধুমাত্র মূল বেতনের ক্ষেত্রে নয়, বিধায়কদের ভাতার ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায় এই বৈষম্য।
‘দ্য প্রিন্ট’ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেলঙ্গানায় বিধায়কদের মাসিক বেতন সব থেকে বেশি। ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। মহারাষ্ট্রের বিধায়কদের মাসিক বেতন ২ লক্ষ ৩০ হাজার। হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং উত্তরাখণ্ডের বিধায়কদের বেতনও দু’লক্ষের বেশি।
অন্য দিকে, দিল্লি, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলের বিধায়কদের মাসিক বেতন তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম। এঁদের প্রত্যেকেরই বেতন ৫০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মধ্যে। তবুও এই রাজ্যগুলির বেশ কিছু বিধায়ক বেতন বাড়াতে বলার বিপক্ষে।
আরবিআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, রাজস্থান, বিহার এবং কেরল দেশের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত রাজ্য। আর এই সব রাজ্যের বিরোধী বিধায়কদের দাবি, এই কারণেই তাঁরা বিধায়কদের বেতন বাড়াতে বলে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে চান না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় সিংহের মতে, বিধায়কেরা সব রাজ্যেই প্রায় এক কাজ করেন। তাই এই বেতন-বৈষম্যের পিছনে কোনও সঠিক যুক্তি নেই বলেও তিনি দাবি করেছেন।
নিয়ম বলছে, বিধায়কেরা চাইলে অন্য পেশায় যুক্ত থাকতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁরা বিধায়ক হিসাবে যে বেতন পান, তা থেকে বঞ্চিত থাকবেন।
সাধারণত, এক জন বিধায়কের মূল বেতন এবং ভাতা মিলিয়ে যে টাকা হয়, তার পুরোটাই ওই বিধায়কের মাসিক বেতন হিসাবে ধরা হয়। ফোন এবং যাতায়াতের জন্যও কিছু নির্দিষ্ট ভাতা পেয়ে থাকেন বিধায়কেরা।
এমন কিছু রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আছে, যেখানে বিধায়কদের ফোন, বিদ্যুৎ বিলের খরচ-সহ অন্যান্য বিভিন্ন খরচ মূল বেতনের বাইরে রাখা হয়।
এক জন বিধায়ক নির্বাচনী কেন্দ্র এবং তার বাইরে যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন। ব্যক্তিগত সচিব এবং বাড়ি ভাড়া-বাবদ ভাতা পান বিধায়করা। তবে প্রাথমিক ভাবে বিধায়কদের নিজেদেরই এই টাকা দিতে হয়। পরে এই টাকা তাঁদের ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়।
বিধায়কের মাসিক মূল বেতন ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু ফোন, যানবাহন এবং অন্যান্য বিভিন্ন ভাতা মিলিয়ে সেই টাকা দাঁড়ায় লক্ষাধিক।
সম্প্রতি দিল্লি বিধানসভা বিধায়কদের বেতন ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি মাসে ৯০ হাজার টাকা করার জন্য একটি বিল পাশ এনেছে। দিল্লিতে বিধায়কদের বেতন ১১ বছর আগে শেষ বার সংস্কার করা হয়েছিল।
যদি বিল পাশ হয়ে আইন হয়, তবে দিল্লির বিধায়কদের বেতন বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে দিল্লির এক জন বিধায়ক মূল বেতন হিসেবে ৩০ হাজার, নির্বাচনী ভাতা হিসেবে ১০ হাজার এবং অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা পাবেন।
বিধায়কদের বেতন সংশোধনী আইন অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধায়কদের ব্যক্তিগত সহকারীর জন্যও ভাতা দেওয়া হয়। কিছু রাজ্যে বিধায়কদের গাড়ির চালকদের বেতন দেওয়ার জন্যও ভাতা দেওয়া হয়।
কেরলের এক বিধায়কের মূল বেতন দাঁড়ায় দু’হাজার টাকা। তবে সমস্ত ভাতা যোগ করে মোট বেতন হয় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। আবার অসমের এক বিধায়কের মূল বেতন ৮০ হাজার টাকা। ভাতা যোগ করে তাঁর বেতন বেড়ে হয় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা।
হিমাচল প্রদেশে বিধায়কেরা নিজস্ব গাড়িতে যাতায়াতের জন্য জ্বালানির খরচ বাবদ কিলোমিটার প্রতি ১৮ টাকা করে পান। কিন্তু বাস, ট্যাক্সি বা গণপরিবহনে যাতায়াতের জন্য প্রতি কিলোমিটারের হিসাবে ভাতা বাবদ ২ টাকা করে পান।
ছত্তীসগঢ়ে বিধায়কদের নিজস্ব যানবাহন ব্যবহারের জন্য প্রতি কিলোমিটারে জ্বালানির খরচ হিসেবে ১০ টাকা করে দেওয়া হয়। তবে রেল এবং বিমানে ভ্রমণের পুরো খরচই রাজ্য সরকার বহন করে।
বিজেপি ক্ষমতায় নেই এমন রাজ্যগুলির বিধায়কদের দাবি, জ্বালানির দাম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি বাবদ যে টাকা দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়।
আবার তেলঙ্গানা রাজ্যের বিধায়কেরা অন্যান্য রাজ্যের বিধায়কদের তুলনায় বেশি বেতন পাওয়া সত্ত্বেও সেই রাজ্যের অনেক বিধায়ক সন্তুষ্ট নন। ‘দ্য প্রিন্ট’ সংবাদমাধ্যমকে তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস)-র বিধায়ক সঞ্জয় কুমার জানান, বিধায়কদের প্রায়ই তাঁদের ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগ বাড়াতে নির্বাচনী কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘সরকারের কাছ থেকে আমরা যে পরিমাণ টাকা পাই, তাতে এক সপ্তাহও চলে না।’’ এমনকি, তাঁদের নিজেদের পকেট থেকেও টাকা দিতে হয় বলেও তিনি জানান।
অন্য দিকে, ২০১৩ সালে আম আদমি পার্টি (আপ)-র নেতা সোম দত্ত পাকাপাকি ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দেন। ব্যাঙ্কে কাজ করে সে সময় তিনি মাসিক বেতন পেতেন ৪৫ হাজার টাকা।
৪৫ বছর বয়সী সোম বর্তমানে দিল্লির সদর বাজার বিধানসভার বিধায়ক। বর্তমানে বিধায়ক হিসাবে তাঁর বেতন ৫৩ হাজার টাকা। সোমের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। পরের বছর তাঁর তিন বছরের ছেলেকে সরকারি স্কুলেই ভর্তি করার পরিকল্পনা করছেন তিনি। কারণ বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর খরচ অনেক বেশি।
সোম তাঁর পৈতৃক দোতলা বাড়িতে থাকেন। চার চাকা তো দূরের কথা তাঁর কোনও মোটরবাইকও নেই। তবে দিল্লি বিধানসভার বিধায়কদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বিল পাশ হলে সোমের আর্থিক অবস্থা শীঘ্রই ফিরতে পারে।
কেরলে কুন্দারা আসনের কংগ্রেস বিধায়ক পিসি বিষ্ণুনাধ এক সংবাদমাধ্যমকে জানান, তিনি কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দল তাঁকে পরে বিশ্বাস করে প্রার্থী করেন। বিষ্ণুনাধ আরও জানান, ২০০৬ সালে তিনি প্রথম বিধায়ক হন। কিন্তু তার আগে তাঁর কাছে অর্থ উপার্জনের অন্য উপায় ছিল না। তাঁর স্ত্রী একটি প্লে স্কুল চালিয়ে সংসারের খরচ চালাতেন।