জেএসডব্লু গোষ্ঠীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনি। দেশের সব থেকে বড় ইস্পাত সংস্থা জেএসডব্লু স্টিলের মাথা। সেই সজ্জন জিন্দলের বিরুদ্ধেই এ বার উঠল বড় অভিযোগ। ধর্ষণের অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কে এই সজ্জন?
১৯৮২ সালে একটি ইস্পাত কারখানা দিয়ে কেরিয়ার শুরু সজ্জনের। তার পর দেশের অন্যতম বড় ইস্পাত সংস্থা টাটা স্টিলকেও অনেকটাই পিছনে ফেলেছে জেএসডব্লু স্টিল। সেই পথটা সহজ ছিল না।
এতটা পথ পেরিয়ে সেই সজ্জনের বিরুদ্ধেই উঠল অভিযোগ। বুধবার মুম্বইয়ের এক থানায় দায়ের হয়েছে এফআইআর। এক অভিনেত্রী তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন।
ওই অভিনেত্রী প্রথম অভিযোগ এনেছিলেন গত ফেব্রুয়ারি মাসে। মুম্বইয়ের বান্দ্রা কুর্লা কমপ্লেক্স থানায় অভিযোগ করেন তিনি। অভিনেত্রীর দাবি, পুলিশ প্রথমে সেই অভিযোগে আমল দেয়নি।
নির্যাতিতা দাবি করেন, তিনি বাধ্য হয়ে বম্বে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন আইনজীবী রিজওয়ান মার্চেন্ট এবং গায়ত্রী গোখলের মাধ্যমে। শেষে আদালতের হস্তক্ষেপে এফআইআর দায়ের করেছেন অভিনেত্রী।
মহিলার করা পুলিশি অভিযোগ থেকে জানা গিয়েছে, ২০২১ সালে দুবাইয়ে আইপিএল ম্যাচ চলাকালীন সজ্জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। দু’জনেই ভিআইপি বক্সে বসেছিলেন।
অভিনেত্রীর বয়ান থেকে জানা গিয়েছে, পরে জয়পুরে সাংসদ প্রফুল্ল পটেলের ছেলের বিয়েতে দেখা হয় তাঁদের। তাঁদের মধ্যে ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়। দেখা হয় মুম্বইয়েও।
অভিনেত্রী দাবি করেন, সেখানে তাঁর ভাইয়ের একটি সম্পত্তি কিনতে সজ্জন আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তখন থেকে তাঁকে ‘বেবি’ বলে ডাকতেন সজ্জন। একান্ত সাক্ষাতে প্রায়ই নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলতেন। মাঝেমাঝেই ‘জড়িয়ে ধরতেন’। তাতে বেশ কয়েক বার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে অভিনেত্রীকে।
অভিনেত্রীর অভিযোগ, ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি তাঁকে যৌন হেনস্থা করেন সজ্জন। অভিনেত্রীর দাবি, প্রথমে সজ্জন ক্ষমা চাইলেও পরে হুঁশিয়ারি দেন। কেউ জানতে পারলে পরিণাম ভাল হবে না বলে জানান। পরে অভিযোগকারীর যোগাযোগ করার সব রকম পথ বন্ধ করে দেন তিনি।
এই সজ্জনের পরিচয় কী? সজ্জনের বাবা ওমপ্রকাশ জিন্দলের বাবা ছিলেন কৃষক। নিজের চেষ্টায় ২২ বছর বয়সে হিসারে ছোট্ট একটি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে পাইপ তৈরির কারখানা শুরু করেন। প্রথম কারখানাটি তিনি খুলেছিলেন কলকাতায়। নাম জিন্দল স্ট্রিপস। তিনি সাংসদও ছিলেন।
সজ্জনের ছোট ভাই নবীন কংগ্রেসের সাংসদ ছিলেন। জিন্দল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ারের মাথায় রয়েছেন তিনি।
বেঙ্গালুরুর রামাইয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সজ্জন। ১৯৮২ সালের যোগ দেন বাবার ওপি জিন্দল গোষ্ঠীতে।
এক বছরের মাথায় মুম্বই চলে আসেন তিনি। সংস্থার পশ্চিমাঞ্চলের কাজকর্ম সামলাতে শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে মুম্বইয়ের কাছে নতুন একটি ইস্পাত কারখানার দায়িত্ব পান জিন্দল। দু’বছরের মধ্যে সেই সংস্থায় উৎপাদন শুরু হয়ে যায়।
এর পর আরও বড় চ্যালেঞ্জ নেন সজ্জন। কর্নাটকের বিজয়নগরে নতুন ইস্পাত কারখানা চালু করেন তিনি। এই সংস্থার বৃদ্ধিই বলে দেয়, ব্যবসা নিয়ে জিন্দলের প্যাশন, দক্ষতা। ২০২২ অর্থবর্ষে জেএসডব্লু স্টিল সংস্থার রাজস্বের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।
২০২২ অর্থবর্ষে জেএসডব্লু এনার্জির আয় বৃদ্ধি হয় ১৮ শতাংশ। ওই অর্থবর্ষে সংস্থার আয় ছিল আট হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। কয়লার পরিবর্তে হাইড্রোজেন দিয়ে জ্বালানি ‘গ্রিন স্টিল’ তৈরির দৌড়ে একেবারে সামনে রয়েছে সজ্জনের এই সংস্থা।
ব্যবসার পাশাপাশি খেলাধুলো নিয়েও দারুণ আগ্রহ সজ্জনের। অলিম্পিকের প্রশিক্ষণের জন্য দেশের অন্যতম সেরা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন তিনি। কর্নাটকের বিজয়নগরে ইনস্পায়ার ইনস্টিটিউট অফ স্পোর্টস (আইআইেস) গড়ে তুলেছেন তিনি।
এই জিন্দল গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ রয়েছে বাংলারও। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে ইস্পাত এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য প্রায় ৪,৩৩৪ একর জমি দেওয়া হয়েছিল জিন্দলদের। ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর জিন্দল গোষ্ঠীর সেই কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেখান থেকে ফেরার পথে তাঁদের লক্ষ্য করে ল্যান্ডমাইন হামলা চালায় মাওবাদীরা।
ওই ঘটনার পর পুলিশি নিপীড়নের অভিযোগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটি’। শুরু হয়েছিল ‘লালগড় আন্দোলন’। শেষ পর্যন্ত জিন্দল গোষ্ঠী ইস্পাত এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে। পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল সেই জমি।
২০১৪ সালের জুলাই মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, জমি ফেলে রাখা যাবে না। এর পরে বিকল্প শিল্প হিসাবে ১৩৫ একর জমিতে সিমেন্ট কারখানা তৈরি করেন জিন্দলেরা। শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জমি রেখে বাকিটা ফেরত দিতে চান জিন্দলরা বলে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি সেই জমিরও মাপজোক হয়। সেই লিজ় জমির মালিকানা দেওয়া হয়েছে জিন্দলদের। এর মধ্যেই সজ্জনের নামে অভিযোগ।
জিন্দলের স্ত্রীর নাম সঙ্গীতা জিন্দল। তিনি জেএসডব্লু ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন। দম্পতির দুই মেয়ে তারিণী, তনভি এবং এক ছেলে পার্থ রয়েছেন।
২০১২ সালে জেএসডব্লিউ স্টিলের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কর্নাটকে লোহা খননের মামলায় নাম জড়িয়েছিল সংস্থার আধিকারিক এবং রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিএস ইয়েদুরাপ্পা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত করে সিবিআই। ২০১৬ সালে ইয়েদুরাপ্পা-সহ সংস্থার কর্তাদের বেকসুর খালাস করে সিবিআই আদালত। এ বার নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এখনও মুখ খোলেননি সজ্জন।