ছোটবেলা থেকেই মাটির খেলনার প্রতি ঝোঁক ছিল। মাটির তৈরি হস্তশিল্পও টানত তাঁকে। এতটাই যে, মুগ্ধ হয়ে সেগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলেন। অবসাদ কাটাতে কড়া ওষুধও খেতে হত। সেই ওষুধের প্রভাবে সারা ক্ষণই ঝিমিয়ে থাকতেন। তা কাটাতে ছোটবেলার শখকে আঁকড়ে ধরেন কাশ্মীরের এক তরুণী। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও নেশায় তিনি কুমোর।
কাশ্মীর উপত্যকার প্রাচীন মৃৎশিল্পকে পুনরুজ্জীবনের পথে নিয়ে যেতে চান সাইমা শফী। সমাজমাধ্যমে যিনি নিজেকে ‘ক্লাল কুর’ নামে পরিচয় দেন। কাশ্মীরি ভাষায় যার অর্থ কুমোর মেয়ে।
কাশ্মীরের পূর্ত দফতরে সারা দিনের কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরে ‘অন্য কাজে’ বসে পড়েন সাইমা। পূর্ত দফতরের সিভিল ই়ঞ্জিনিয়ার সাইমা তখন মাটির নরম ঢেলায় হাত ঘুরিয়ে খেলনা, কাপ-প্লেট, থালা-বাটি তৈরিতে বুঁদ মৃৎশিল্পী।
হরেক রকম খেলনা বা ঘরকন্নার জিনিসপত্র ছাড়াও মাটি দিয়ে ফুলদানি, টব, খুচরো রাখার ভাঁড়— এ ধরনের জিনিস গড়েন সাইমা। মৃৎশিল্পের মাধ্যমে তিনি যেন নিজের অবসাদের দাওয়াই খুঁজে পেয়েছেন। পাশাপাশি, এই শিল্পের মাধ্যমে আধুনিক কাশ্মীরিদের কাছে প্রভাবী হয়ে উঠেছেন।
সাইমা জানিয়েছেন, ব্যক্তিজীবনে নানা সমস্যার জেরে গভীর অবসাদে ডুবে গিয়েছিলেন। মনোবিদের সাহায্য নেওয়া ছাড়াও অবসাদ কাটাতে একাধিক কড়া ওষুধ খেতে হত তাঁকে। সাইমা বলেন, ‘‘একসঙ্গে এত ওষুধ খাওয়ার জেরে ঝিমিয়ে পড়তাম। বিষণ্ণ থাকতাম।’’
ওই অবস্থায় মৃৎশিল্পে মন গিয়েছিল ৩৩ বছরের সাইমার। তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই মাটির তৈরি শিল্পকর্ম মুগ্ধ করত আমাকে। অবসাদ কাটাতে তাই সে দিকেই ঝুঁকেছিলাম।’’
মৃৎশিল্পী হয়ে ওঠার নেপথ্যে চিনা দার্শনিক লাও ছু’র লেখনীও উদ্বুদ্ধ করেছিল সাইমাকে। লাওয়ের উক্তি ছিল, ‘‘আমরা মাটি দিয়ে পাত্র গড়ি। মাটির গভীরে যে শূন্যতা থাকে আসলে তা দিয়েই আমরা ইচ্ছামতো পাত্রের রূপ দিতে পারি।’’
সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের কাছে সাইমা বলেন, ‘‘লাওয়ের ওই লাইনটা পড়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম নিজের অবসাদকে কোথায় জমা রাখতে হবে।’’ অবসাদ কাটাতে এর পর মৃৎশিল্পকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন সাইমা।
মাটি দিয়ে হরেক জিনিস গড়ার নেশা চেপে বসলেও গোড়ায় বেশ কয়েকটি বাধার মুখে পড়েছিলেন শ্রীনগরের এই তরুণী। সাইমা বলেন, ‘‘এ ধরনের কাজে যে আর্থিক সঙ্গতি থাকাটা জরুরি, তা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।’’
মাটির জিনিসপত্র গড়তে বৈদ্যুতিন চাকা বা গ্যাসের চুল্লির মতো যে সমস্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি দরকার, তা কিনতে যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন ছিল সাইমার। উপত্যকায় সে সবের জোগান ছিল না।
কাশ্মীরে বসে এ কাজ শেখার কোনও উপায় ছিল না বললেই চলে। মাটি দিয়ে জিনিসপত্র গড়ার কাজ শিখতে বেঙ্গালুরু পাড়ি দিয়েছিলেন সাইমা।
বেঙ্গালুরুতে ছোট একটি কোর্স করেছিলেন তিনি। কাশ্মীরিদের ঘরকন্নার বাসনপত্র থেকে শুরু করে মাটির নানা পাত্র তৈরির কাজও সে শহরেই শিখেছিলেন সাইমা।
মৃৎশিল্পী হয়ে ওঠার পথে সাইমার কাছে আরও ‘দেওয়াল’ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে পৃথক রাজ্য হিসাবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করায় উপত্যকার পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। অন্য দিকে, অতিমারির আবহে লকডাউন শুরু হয়েছিল।
বেঙ্গালুরুতে পোড়ামাটি থেকে শুরু করে মাটি দিয়ে আধুনিক কাজও হাতেকলমে শিখেছিলেন সাইমা। তবে উপত্যকায় ফিরে উপলব্ধি করেছিলেন, মহিলা হিসাবে মৃৎশিল্পী হওয়ার পথে সামাজিক বাধা রয়েছে।
সাইমা বলেন, ‘‘আমাদের উপত্যকায় যে সমস্ত পরিবারে এখনও মাটির কাজ করা হয়, সেখানে মহিলারা কখনও এ কাজে আসেন না।’’ এই পরিস্থিতি যে বাস্তব তা স্বীকার করেন কাশ্মীরের বদগাঁওয়ের মৃৎশিল্পী গুলাম আহমেদ কুমার। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, উপত্যকায় কুমোরদের বিশেষ সামাজিক প্রতিপত্তি নেই। গুলাম আহমেদ বলেন, ‘‘এই শিল্পের উপর এক ধরনের সামাজিক চোখরাঙানি রয়েছে। আমরা যে কুমোর, তা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করি।’’
উপত্যকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল হতেই আবার কাজে লেগে পড়েছিলেন সাইমা। উপত্যকায় বসেই সেখান থেকে গ্যাসের চুল্লির ভিতরের দেওয়াল গড়়েছিলেন। সে জন্য চেন্নাই থেকে টাইল্স কিনে শ্রীনগরে নিয়ে এসেছিলেন। হরিয়ানা থেকে বিশেষ ধরনের মাটিও জোগাড় করেছিলেন।
মহিলা মৃৎশিল্পী হিসাবে পরিচিতি বাড়ানোর পাশাপাশি কাশ্মীরের এই প্রাচীন শিল্পকে নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে সমাজমাধ্যমকে হাতিয়ার করেছেন সাইমা। ‘ক্লাল কুর’ নামে ইউটিউবে একটি চ্যানেল রয়েছে তাঁর। সেখানে মাটির কাজ শেখানো ছাড়াও নতুনদের এ বিষয়ে উৎসাহ দেন তিনি।
মাটির কাজ শেখাতে শ্রীনগরে নিজের একটি স্টুডিয়ো খুলেছেন সাইমা। তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই এ কাজ শিখতে চান। সে জন্য এই স্টুডিয়ো খোলা।’’ তাতে বেশ কয়েক জন শিক্ষার্থী পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া, উপত্যকায় বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীও করেছেন তিনি।
সাইমার উদ্যোগে নড়েচড়ে বসেছে কাশ্মীর সরকারও। গত বছর কাশ্মীরের হস্তশিল্প দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা শরিক ইকবাল লোন সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘‘মৃৎশিল্পীদের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করতে চাই আমরা। কাশ্মীরের এই প্রাচীন শিল্পকে সংরক্ষণ করা ছাড়াও তাঁদের আধুনিক যন্ত্রপাতি দেওয়ারও বন্দোবস্ত করব।’’
সাইমা বলেন, ‘‘মাটি দিয়ে জিনিসপত্র গড়াটা অনেকের কাছেই কেবলমাত্র শখ। তবে বেশ কয়েক জন একে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে চান। তবে এ পেশায় আসার জন্য মেয়েদের উৎসাহিত করতে পারলে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।’’