বলিউডে মন মজেছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। অমিতাভ-শাহরুখ-সলমন-আমির থেকে হালফিলের নওয়াজ়উদ্দিন-কার্তিক আরিয়ান। কৃতি-আলিয়া হোক বা দীপিকা পাডুকোন। নাম না করে তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাদামি ভালুকের দেশের সর্বময় কর্তা।
চলতি বছরের ২২ অক্টোবর থেকে রাশিয়ার কাজান শহরে শুরু হচ্ছে ‘ব্রিকস’ সম্মেলন। এই সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। ভোলগা নদীর সঙ্গমে তাঁর পা পড়ার আগে রুশ প্রেসিডেন্টের এই ‘বলিউড প্রশস্তি’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ব্রিকস সম্মেলনের মুখে মস্কোর ক্রেমলিনের প্রাসাদে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন পুতিন। সেখানে তিনি বলেন, ভারতীয় চলচ্চিত্র, বিশেষত বলিউড সিনেমা রাশিয়ায় সর্বাধিক জনপ্রিয়।
রুশ প্রেসিডেন্টের এ হেন মন্তব্যের পরেই উড়ে আসে প্রশ্নবাণ। এ বার কি তবে ব্রিকসের সদস্য দেশগুলির সিনেমার শুটিংয়ে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেবে মস্কো? অকপটে এর জবাব দেন পুতিন।
‘‘আপনারা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন ব্রিকসের সদস্য দেশগুলির মধ্যে এখানে ভারতীয় চলচ্চিত্র সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমাদের একটা টিভি চ্যানেল রয়েছে, যেখানে সর্ব ক্ষণ শুধু ভারতীয় সিনেমাই দেখানো হয়। সে দেশের ছায়াছবি নিয়ে আমাদের দারুণ আগ্রহ রয়েছে।’’ বলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
চলতি বছরে ‘মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এ যে ব্রিকস দেশগুলির সিনেমা থাকবে, তা স্পষ্ট করেছেন রাশিয়ার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। পুতিনের কথায়, ‘‘ভারত আগ্রহ দেখালে আমরা সে দেশের সিনেমার প্রচার করব। এ ব্যাপার মস্কোর মনোভাব যথেষ্ট ইতিবাচক।’’
ছায়াছবি বাদে ভারতীয় ফার্মা সংস্থা নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। ‘‘এ ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলতে প্রস্তুত। আমরা চুক্তিতে যেতে পারি। আর তাতে কোনও অসুবিধা হবে না।’’ বলেছেন ক্রেমলিনের সর্বময় কর্তা।
এর পরই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সিনেমা থেকে ফার্মা, মস্কোর প্রস্তাব যে মোদী ফেরাবেন না, তা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন তিনি।
‘বন্ধু’ মোদীর কথা উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ‘‘আমরা যে এই বিষয়গুলিতে একমত হতে পারবে, তা নিয়ে আমি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত। এতে কোনও সমস্যা হবে।’’
আগামী দিনে নাট্য উৎসব ও সিনেমা অ্যাকাডেমি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে রাশিয়ার। এ ব্যাপারে ব্রিকসের দেশগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
ইতিহাসগত ভাবে দীর্ঘ দিন ধরেই রাশিয়ায় জনপ্রিয় বলিউড সিনেমা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর মূল কারণ হল দু’টি দেশের প্রায় একই ধরনের সামাজিক গঠন। ফলে রুশ জনতার পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে ভারতীয়দের মিল রয়েছে।
বলিউডি চলচ্চিত্রে ঘুরেফিরে এসেছে নিম্নবিত্ত ও ধনীর গল্প। সেখানে ভাল ও মন্দের স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। যা রুশ নাগরিকদের স্বাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাশিয়ান সিনেমাতেও এই ধরনের চিত্রনাট্য রয়েছে ভূরিভূরি।
সোভিয়েত আমলে রাশিয়ায় সর্বাধিক আয় করা ভারতীয় সিনেমা হল ‘ডিস্কো ড্যান্সার’। ১৯৮২ সালে যা মুক্তি পেয়েছিল। এর চিত্রনাট্যকার ছিলেন রাহি মাসুম রাজা। আর মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সদ্য ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরষ্কারপ্রাপ্ত মিঠুন চক্রবর্তী।
ভারতের যে অভিনেতা রুশ জনতার মন জিতে নিয়েছিলেন, তিনি হলেন রাজ কপূর। ১৯৫১ সালে মুক্তি পায় ‘আওয়ারা’। যা মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিল।
গত শতাব্দীর আশির দশকের পরেও বহু ভারতীয় সিনেমা রাশিয়ায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে টিকিট বিক্রির নিরিখে এখনও কেউ ‘আওয়ারা’ ও ‘ডিস্কো ড্যান্সার’-এর রেকর্ড স্পর্শ করতে পারেনি। বাদামি ভালুকের দেশের ১০ কোটি জনতা দেখেছেন রাজ কপূর ও মিঠুন অভিনীত এই দুই চলচ্চিত্র।
শুধু তাই নয়, ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ভাবমূর্তি রাশিয়ার চিন্তাবিদ, কবি, সুরকার ও শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই সাংস্কৃতিক প্রভাবটা ছিল পারস্পরিক। উদাহরণ হিসাবে লিয়ো টলস্টয় ও মহাত্মা গান্ধীর কথা বলেছেন তাঁরা। মহাত্মা সম্পর্কে টলস্টয়ের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা গড়ে উঠেছিল ভারতীয় সভ্যতার আধ্যাত্মিক প্রভাবের জন্যেই।
এ ছাড়া ব্রিকসের দেশগুলির সঙ্গে ভবিষ্যতে সঙ্গীত উৎসব করার কথাও বলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ‘‘সকলের সঙ্গে মিলে এটার পরিকল্পনা করা হবে। যাতে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ভাল ভাবে হতে পারে। আর কাজের জায়গাটাও খোলা থাকে।’’ সম্মেলন শুরুর মুখে ক্রেমলিনে বসে বলেছেন তিনি।
বর্তমানে যুদ্ধবিমানের স্বল্পতায় ভুগছে ভারতীয় বায়ুসেনা। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এ বারের ব্রিকস সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এই নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
পাশাপাশি, দুনিয়া জুড়ে চলা ‘ডলার রাজ’ শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন পুতিন। আমেরিকান মুদ্রার দাদাগিরি বন্ধ করতে ব্রিকসে একাধিক বড় সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আরও কিছু দেশের সঙ্গে সরাসরি নিজের দেশের টাকাতেই বাণিজ্য করতে পারবে নয়াদিল্লি।
২০০৯ সালের ১৬ জুন চারটি দেশের উদ্যোগে তৈরি হয় ব্রিকস। সেগুলি হল, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চিন। পরবর্তী কালে এতে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, মিশর, ইথিয়োপিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে পাকিস্তানও।