মস্কো দখলের চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। কিন্তু তোলপাড় ফেলেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মাঝপথেই থমকে যায় তাঁর ভাড়াটে সেনাবাহিনী। তার পর থেকেই আর খোঁজ মিলছে না ‘ওয়াগনার’ বাহিনীর মালিক ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের।
কেউ বলছেন, প্রিগোঝিন রাশিয়া ছেড়ে পালিয়েছেন। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজ়ান্ডার লুকাশেঙ্কোর দাবি, ওয়াগনার প্রধান রাশিয়াতেই রয়েছেন। ক্রেমলিন জানিয়েছে, প্রিগোঝিনের গতিবিধি অজানা। মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বলেন, ‘‘ওঁর গতিবিধি আমাদের জানা নেই। আমাদের সেই ক্ষমতা নেই, ইচ্ছাও নেই।’’
তা হলে প্রিগোঝিন কোথায় গেলেন? বেলারুশ বা রাশিয়া— প্রিগোঝিনকে নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ কোনও তরফেই দেখা যাচ্ছে না। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, আদৌ বেঁচে আছেন তো ওয়াগনার প্রধান?
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ভূমিপুত্র প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। একদা তাঁরই দক্ষিণ হস্ত প্রিগোঝিনের জন্ম, কর্ম— সবই সেই সেন্ট পিটার্সবার্গে। এই শহরেই ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের সদর দফতর। বিশাল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অট্টালিকা নির্মাণশিল্পের অন্যতম নিদর্শন।
এই পরিস্থিতিতে জানা গিয়েছে, মস্কো দখলের ব্যর্থ অভিযানের পরে প্রিগোঝিনের ভিলা এবং ওয়াগনারের সদর দফতরে হানা দিয়েছিল রুশ পুলিশ। সেন্ট পিটার্সবার্গের সেই ভিলায় ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ পুলিশের। সেখানে তল্লাশিতে এমন অনেক জিনিস উদ্ধার হয়েছে, যা মূলত পরিচয় গোপনের কাজে লাগে। যা দেখে হতবাক অবস্থা পুলিশেরও।
আধুনিক বিশ্বে সম্ভ্রান্ত, অভিজাত এবং প্রভাবশালীদের বাড়িতে একটি জিনিস পাওয়া যাবেই। তা হল চোখধাঁধানো গাড়ির সম্ভার। কিন্তু ‘রুশ অলিগার্ক’ প্রিগোঝিন সে সবের ধার ধারেন না। গাড়ি নয়, তাঁর শখ হল হেলিকপ্টার। আর পাঁচটা ধনী লোকের বাড়িতে যেখানে মিলবে গাড়ি, সেখানে প্রিগোঝিনের ভিলায় সযত্নে রাখা হেলিকপ্টার!
সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রিগোঝিনের ভিলাটি বিশাল এলাকা জুড়ে। সাদা দেওয়াল পেরোলেই সবুজ ঘাসের গালিচা। এক কোণে ‘পার্ক’ করা একটি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার। প্রয়োজন মতো সেই হেলিকপ্টারে চড়েই প্রিগোঝিন চলে যেতেন যে কোনও জায়গায়।
চারপাশে কেয়ারি করা বাগানের মাঝখান দিয়ে শানবাঁধানো লম্বা পথ পেরিয়ে তার পর প্রাসাদ। গাড়ি বারান্দা পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রথম যেখানে পা পড়বে, তা হল প্রিগোঝিনের বসার ঘর। দাবা খেলার বোর্ডের আদলে তৈরি চকমেলানো মেঝে। চারপাশে দামি আসবাব। মহার্ঘ কাঠ দিয়ে মোড়া এই ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন অন্তত একশো জন।
পুলিশের কয়েক জন কর্মী তল্লাশিতে গিয়ে পথ ভুল করে চলে এসেছিলেন ওয়াগনার প্রধানের স্নানঘরে। সেখানে তাঁদের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। বিশাল আকৃতির স্নানঘরের কোণে মার্বেল পাথরে মোড়া বাথটাব। বাথটাবে পৌঁছনোর জন্য দু’দিকে সিঁড়ি, কালো পাথরে মোড়া। বাথরুমের এক কোণে বিরাট ‘ফ্রেঞ্চ উইনডো’। তার পাশে বসানো দু’টি ডেক চেয়ার। সূর্যের তাপ নিতে নিতে স্নানের আদর্শ স্থান।
চানঘরে স্নানে মন না চাইলে রয়েছে সুইমিং পুলও। ইনডোর পুলে জলের উচ্চতা বৃদ্ধির কৃত্রিম ব্যবস্থাও মজুত। পুলের ঠিক পাশেই বসানো একটি ‘মাসাজ বেড’। এ পাশে-ও পাশে ছড়ানো আরও গোটা দুই ডেক চেয়ার। রয়েছে ছোটদের খেলা করার খেলনা। রয়েছে জ়াকুজ়িও।
আবার অবাক হওয়ার পালা পুলিশের। এ বার তাঁরা পৌঁছন প্রিগোঝিনের ভিলার অন্য একটি ঘরে। সেখানে রাখা একটি পেল্লায় আলমারি। তা খুলতেই বেরিয়ে আসে থরে থরে সাজানো পরচুলা। তা হলে কি রূপ বদলে ঘুরে বেড়াতেন প্রিগোঝিন? না হলে আলমারিতে এত পরচুলা কেন?
অবাক হওয়ার আরও বাকি। প্রিগোঝিনের অন্য একটি বসার ঘরে ঢোকার মুখের প্যাসেজে কাঠের মাঝারি আলমারির উপর যত্নে রাখা একটি অতিকায় কুমিরের খোলস। উপরে চোখধাঁধানো ঝাড়লণ্ঠন।
এ বার পুলিশের গন্তব্য ওয়াগনার প্রধানের কাজের ঘর। অর্থাৎ, যে ঘরে বসে কাজকর্ম সামলাতেন প্রোগোঝিন। সেই ঘরের এক দিকে একটি পুল টেবিল। অন্য দিকে কাঠের টেবিলের এক পাশে কালো প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাশিয়ার রুবল। গোটা ঘরটি সাজানো বিভিন্ন আকৃতির মানুষের মাথার প্রতিকৃতি দিয়ে।
তবে আসল সম্ভার লুকনো ছিল প্রিগোঝিনের শোয়ার ঘরে। অতিকায় পালঙ্কের এক ধারে পুরোদস্তুর অস্ত্রশালা। তাতে দেখা গিয়েছে একটি অতিকায় রাইফেল। এ ছাড়াও ছড়ানো-ছেটানো অবস্থায় পড়ে একাধিক বন্দুক, পিস্তল, রাইফেল। কার্তুজবোঝাই অন্তত দু’টি সুটকেসও মিলেছে ডালা খোলা অবস্থায়।
শোয়ার ঘরেরই একটি অংশ সোজা চলে গিয়েছে প্রিগোঝিনের খেলার ঘরে। সেখানে রাখা বিলিয়ার্ড টেবল। রয়েছে একটি অতিকায় হাতুড়িও। অনলাইনে এমন একাধিক ছবি, ভিডিয়ো রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, হাতুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রিগোঝিন। তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, উপরমহলের নির্দেশ মেনে সেটি দিয়ে কিছু ক্ষণ আগেই কোনও এক জনকে নিকেশ করেছেন। ফলে তাঁর বাড়িতেও যে হাতুড়ি থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
রাশিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমের দাবি, প্রিগোঝিনের ভিলা থেকে বিপুল নগদ টাকা উদ্ধার হয়েছে। তাদের অনুমান, ৬৫ লক্ষ ডলার অর্থমূল্যের রাশিয়ার মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। যদিও ঠিক কত টাকা উদ্ধার হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে থরে থরে সাজানো নোটের বান্ডিল দেখা গিয়েছে প্রকাশিত ছবিতে।
রাশিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ওই ভিলা থেকে একাধিক পাসপোর্টও পাওয়া গিয়েছে। সেই পাসপোর্টগুলিতে নাম রয়েছে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোঝিনের। কিন্তু প্রতিটিতে ছবি আলাদা আলাদা। এ থেকেই সন্দেহ, প্রিগোঝিন সেজে কি তা হলে অন্যেরাও ঘুরে বেড়াতেন? সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, ইদানীং যাঁকে প্রিগোঝিন বলে দাবি করা হচ্ছে, তিনিই আসল লোক তো?
১৯৬১ সালের ১ জুন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাদ (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) শহরে জন্ম প্রিগোঝিনের। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ‘ক্রস-কান্ট্রি স্কিয়ার’ হওয়ার। কিন্তু জীবন চলে সম্পূর্ণ অন্য পথে। ২০০০ সাল নাগাদ পুতিনের কাছাকাছি চলে আসেন তিনি। তার পর আর পিছন ফিরে দেখতে হয়নি দুনিয়ার অন্যতম ভয়ঙ্কর ভাড়াটে বাহিনীর প্রধানকে।
সেই প্রিগোঝিনই দু’সপ্তাহ আগে অসন্তোষের অভিযোগে মস্কো অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎই বিদ্রোহ থামিয়ে বেলারুশের উদ্দেশে রওনা দেন ওয়াগনার নেতা প্রিগোঝিন। কেন পিছু হটেছিলেন তিনি, আজও জানা যায়নি। ওয়াগনার বাহিনী এবং রুশ সরকারের মধ্যে লুকাশেঙ্কো শান্তি সমঝোতা করলেও তিনি কী বুঝিয়েছিলেন, তা-ও অজানা। তা ছাড়া কেনই বা বেলারুশে গেলেন প্রিগোঝিন, তা-ও রহস্য থেকে গিয়েছে। বিদ্রোহ থামার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেননি প্রিগোঝিন। ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, আদৌ বেঁচে আছেন তো ওয়াগনার নেতা?
কূটনীতিকদের বক্তব্য, রাশিয়া যতই অস্বীকার করুক, তারা ঠিকই জানে প্রিগোঝিন কোথায়। তারা শুধু বোঝাতে চাইছে, প্রিগোঝিন বা ওয়াগনার গ্রুপ নিয়ে আর তাদের মাথাব্যথা নেই। যুদ্ধ বিশ্লেষকদের একাংশের বক্তব্য, এমনও হতে পারে কিছু দিন বাদে সেনা-বিদ্রোহের খবরই অস্বীকার করবে রাশিয়া।