পোশাকি নাম ‘হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’ (হিমার্স)। আদতে রাশিয়ার হামলা ঠেকাতে ইউক্রেন সেনার ‘অন্তিম আশ্রয়’। আমেরিকা থেকে আমদানি করা এইএম-১৪২ মাল্টিপল রকেট লঞ্চারের ‘সৌজন্যেই’ গত দেড় মাস ধরে রুশ ফৌজের অগ্রগতি অনেকটাই রুখে দিতে পেরেছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অনুগত বাহিনী।
হিমার্সের এমন সাফল্য দেখার পরে ইউক্রেনের প্রতিবেশী পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়ার মতো দেশ আমেরিকার কাছে এই ক্ষেপণাস্ত্র কেনার দরবার শুরু করেছে বলে পেন্টাগন সূত্রে জানা গিয়েছে।
মে মাসে মারিয়ুপোল। জুনের গোড়ায় সেভেরোদোনেৎস্ক। এর পর গত দেড় মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাহিনী ইউক্রেনের তেমন কোনও এলাকা দখল করতে পারেনি। বরং কিভের প্রতিআক্রমণে বেশ কিছু এলাকা হাতছাড়া হয়েছে রুশ সেনার। এমনকি, সীমান্ত লাগোয়া ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলেও (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়) তেমন সাফল্য মেলেনি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ ঘোষণার আগে ওই অঞ্চলকে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পুতিন। সেখান থেকেই প্রথম রুশ সেনার অনুপ্রবেশেরও খবর মেলে। ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ রুশ।
মস্কো-পন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলির সহায়তা সত্ত্বেও ডনবাসে প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি রুশ ফৌজ। তাদের তৎপরতাকে হিমার্সের সহায়তায় ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে ইউক্রেন।
যুদ্ধের গোড়ায় রুশ ট্যাঙ্ক বহরকে রোখায় জন্য ইউক্রেন সেনাকে এফজিএম-১৪৮ জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছিল আমেরিকা। যুদ্ধক্ষেত্রে যার সাফল্য ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।
দেওয়া হয়েছিল বিমান বিধ্বংসী স্ট্রিংঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্রও। পরবর্তী পর্যায়ে জুনের শেষ পর্বে ১৫৫ মিলিমিটার এম-৭৭৭ হাউইৎজার এবং হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়া হয় ইউক্রেনকে।
যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত মোতায়েনে সক্ষম এই ট্রাকবাহিত ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের শত্রুকে ঘায়েল করা যায়। পাশাপাশি, ৫ কিলোমিটার পাল্লাতেও আঘাত হানা সম্ভব।
ব্যবহার করা যায় বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক ভরা রকেট। ডনবাসের যুদ্ধে রুশ আর্টিলারি (গোলন্দাজ) বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকারিতার প্রমাণ দেওয়ার পরে আমেরিকার কাছ থেকে হিমার্স পেতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রুশ আগ্রাসনের আতঙ্কে থাকা বলকান দেশগুলি।
সম্প্রতি কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্যবাহী জাহাজগুলিকে চলাচলের সুযোগ দিতে সম্মত হয়ে চুক্তি করেছে রাশিয়া। তার অন্যতম কারণ, হিমার্সের পাল্লা বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে আমেরিকার সেনাবাহিনী ব্যবহৃত ‘হিমার্স’ অর্থাৎ হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম (এম-১৪২ হিমার্স)-এর একাধিক বৈশিষ্ট রয়েছে।
ইতিমধ্যেই এস্তোনিয়া ছ’টি হিমার্স এম-১৪২ কেনার জন্য ৫০ কোটি ডলারের বরাত দিয়েছে আমেরিকাকে। লিথুয়ানিয়া দিয়েছে ৩০ কোটির। ধাপে ধাপে কয়েক’শ হিমার্স কেনার জন্য ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে পোল্যান্ড।
কেন এত সফল হিমার্স? হিমার্সের নির্ভুল ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারার মূলে রয়েছে বিশেষ নেভিগেশন ব্যবস্থা। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘গাইরোস্কোপ’ এবং ‘অ্যাক্সেলেরোমিটার সেন্সর’। এর ফলে লক্ষ্যবস্তুর নির্ভুল অবস্থান চিহ্নিত করা যায়।
হিমার্সের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ছয়টি টিউব রয়েছে। এগুলো দিয়ে সাধারণ পাল্লার গাইডেড মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমস বা জিএমএলআরএস ছোড়া হয়। যা বহু দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে পারে।
গত ২৫ জুন প্রথম আমেরিকা থেকে ৮টি হিমার্স পেয়েছিল ইউক্রেন। এর পর থেকে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে সেগুলি ব্যবহার করে রুশবাহিনীর অন্তত ৩০টি সামরিক অবস্থান ধ্বংস করা হয়েছে বলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দফতরের দাবি।