যুদ্ধ করে বিশ্বজয় করার বিষয়টা ইতিহাসে নতুন নয়। কিন্তু ঢাল-তলোয়ার ছাড়া শুধু মাত্র রান্না করার দক্ষতা দিয়ে বিশ্বজয় করার নির্দশন হলেন কলকাতার খানসামারা। কলকাতার বেশ কিছু রাস্তার নাম আজও ‘খানসামা’-র নাম গায়ে সেঁটে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। কারা এই খানসামা? কেনই বা তাঁদের নামে রাস্তা তৈরি হল কলকাতায়?
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কাল। খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ছে হিন্দুস্তানের শাহী শাসন। আর মুঘল সাম্রাজ্যে বুক চিরে মাথা তুলছে বেশ কিছু স্বাধীন অঞ্চল। যারা আদতে মুঘল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও ‘স্বাধীন নবাবি’ হিসাবে পরিচিত ছিল। সেই সব নবাবদের হেঁশেলের দায়িত্বে ছিলেন এক প্রকার রন্ধনশিল্পী, যাঁদের ‘খানসামা’ বলা হত। যাঁরা নবাবদের বিচিত্র রসনাবিলাসকে তৃপ্ত করতেন তাঁদের রান্না দিয়ে।
শেখ ও পাঠান সম্প্রদায়ের মুসলমান এই রাঁধুনিরা তাঁদের রান্নার দক্ষতার জন্যই শুধু বিখ্যাত ছিলেন না, তাঁদের খ্যাতি ছিল রান্নার ব্যাপারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিজস্ব উদ্ভাবনের জন্য। বিরিয়ানি থেকে শুরু করে বিবিধ কবাব, রুটি ও পরোটা, মাংসের অন্যান্য পদ তাঁরা রান্না করতেন। সেই সঙ্গে চলত রান্না নিয়ে বিচিত্র সব পরীক্ষা।
তেমনই একজন ছিলেন শেখ শাহনাওয়াজ, নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাঁধুনি। তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন শিক কবাব আজও খাদ্যরসিকদের জিভে জল আনে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে সিরাজউদ্দৌলার পতন হলেও, খানসামাদের হাতের জাদু ইংরেজদের মন জয় করে নেয়। অনেক ইংরেজই নবাবি জীবনধারা অবলম্বন করা শুরু করেন।
একই ঘটনা ঘটে অযোধ্যার নবাবির পতনের কালে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতায় চলে এলে তাঁর খানসামাদের একাংশ তাঁর সঙ্গে চলে আসে। আর অনেকেই ঠাঁই পান ইংরেজদের ‘কিচেন’-এ। এই সব রান্নাঘরেই জন্ম নেয় এই শহরের নিজস্ব চপ, কাটলেটের মতো ইঙ্গ-ভারতীয় খাবার। বিশ্ব-রেসিপির প্রবাহে খানসামার যুক্ত করেন ‘মাল্লিগাটানি স্যুপ’-এর মতো পদ।
ইংরেজদের একাংশ এই ইঙ্গ-ভারতীয় খাবারের একান্ত ভক্ত হয়ে পড়েন। তাই ইংরেজদের ঘরে অন্য কাজের লোকের চাহিদা না থাকলেও, একজন খানসামার চাহিদা সর্বদাই ছিল তুঙ্গে।
এই খানসামাদের অনেকেই জীবদ্দশায় এমন খ্যাতি লাভ করেন যে, কলকাতায় তাঁদের নামে রাস্তার নামকরণ হতে শুরু করে। সেই সব রাস্তার অনেকগুলির নাম পরে বদলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজও কলকাতার অনেক রাস্তা তাঁদের নাম-চিহ্ন বহন করে চলেছে।
খানসামাদের এই খ্যাতি দেখে তৎকালীন ভারতের বহু রাঁধুনি খানসামা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি দিতেন। বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন মুদিয়ালি এলাকায় ছিল খানসামাদের বাসস্থান। সেই জায়গাটিকে ‘খানসামা পাড়া’ বলা হত। বর্তমানে কংক্রিটের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে খানসামাদের সেই বিখ্যাত অস্তিত্ব।
আমহার্স্ট স্ট্রিট অঞ্চলের ছকু খানসামা লেন এবং পার্ক সার্কাসের চমরু খানসামা লেন আজও স্বমহিমায় রয়ে গিয়েছে। চমরুর খ্যাতি ছিল বিরিয়ানি ও মেগলাই খানা রান্নার জন্য।
তালতলার করিম বক্স খানসামা লেনের নাম সম্পূর্ণ বদলে না গেলেও এখন তা করিম বক্স লেন নামে পরিচিত। শেখ করিম বক্স প্রথমে ছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহাউসির খানসামা। ডালহাউসির পর তিনি আরও ৭ জন গভর্নর জেনারেলের হেঁশেলের দায়িত্বে ছিলেন।
মিসরি খানসামা লেনের নাম বদলে হয়ে গিয়েছে মারকুইস লেন।
রাজা রামমোহন রায় লেনের কাছে পাঁচু খানসামা লেনের নাম বদলে হয়ে গিয়েছে দেবেন্দ্র মুখার্জী রো।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন নিমু খানসামা লেনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইডেন হসপিটাল লেন।
চিৎপুরের পিরু খানসামা লেনের নাম বদলে হয়ে যায় টার্নার রোড।
তালতলার মিয়াজান খানসামা লেন এখন নবাব আব্দুর রহমান স্ট্রিট।
রিপন স্টিট্রের গদাই খানসামা লেনের বর্তমান নাম ইলিয়ট লেন।
খানসামারা নেই। নবাব-সাহেবরাও বিগত। তবে কলকাতা এমনই এক আজব শহর, যেখানে তথাকথিত নগণ্য ‘নেটিভ’ রন্ধনশিল্পীকেও মর্যাদা দিয়ে গিয়েছিলেন শাসক প্রভুরা। হয়তো নিজেদের রসনাতৃপ্তির কৃতজ্ঞতা হিসেবে। খানসামাদের নামে রাস্তা থাক বা না থাক, তাঁদের উদ্ভাবিত অনেক রান্নাই আজও টিকে রয়েছে কলকাতার বিভিন্ন রেস্তরাঁয়।