যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে তার সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর। যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার যত বেশি, সে দেশ অর্থনৈতিক ভাবে তত শক্তিশালী।
বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারই আন্তর্জাতিক বাজারে কোনও দেশের দর বৃদ্ধি করে। এই সঞ্চয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় দেশটির ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি।
ভারতের যাবতীয় বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত আছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)-তে। এই সঞ্চয়ের ওঠানামা প্রতিনিয়ত আরবিআইয়ের সরকারি ওয়েবসাইটে তুলে ধরা হয়।
আরবিআইয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ভারতের মোট সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ৪৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। যার অধিকাংশই ডলার।
ডলার ছাড়াও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সঞ্চিত আছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে। তবে শুধু মুদ্রা নয়, আরবিআইতে সোনাও সঞ্চয় করা হয় বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে। সঞ্চিত সোনার মূল্য বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে যুক্ত হয়।
আরবিআইয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে এই মুহূর্তে ৭৯৪.৬৪ মেট্রিক টন (প্রায় ৮০০ টন) সোনা রয়েছে। গত অর্থবর্ষের চেয়ে এই সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে মোট সঞ্চিত সোনার পরিমাণ ছিল ৭৬০.৪২ মেট্রিক টন। পরিকল্পনামাফিকই সোনার সঞ্চয় বৃদ্ধি করে চলেছে আরবিআই।
আগে আরবিআইয়ের সম্পদ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা হিসাবে সঞ্চিত থাকত। বর্তমানে সোনায় এই সঞ্চয় বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকেছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। শুধু ভারত নয়, একাধিক দেশই এই নীতি নিয়েছে। স্বর্ণসঞ্চয়ে জোর দিচ্ছে তারা।
বৈদেশিক মুদ্রার মধ্যে ডলারের পরিমাণই বেশি। কিন্তু আমেরিকার এই মুদ্রায় এখন আর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি। তাই ডলার নির্ভরশীলতা তারা কমাতে চাইছে। বিকল্প হয়ে উঠছে সোনা।
বিভিন্ন দেশের ডলার বিমুখতার কারণ আমেরিকার বিভিন্ন নীতি। আমেরিকা আচমকা যদি কোনও দেশের উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তবে সেই দেশের কাছে এত দিনের সঞ্চিত ডলার অর্থহীন হয়ে পড়বে।
কূটনৈতিক সম্পর্কে পান থেকে চুন খসলেই নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে আমেরিকা। তা ছাড়া, ডলার যে হেতু তাদেরই হাতে, ডলারের মূল্যে চাইলেই কারসাজি করতে পারে হোয়াইট হাউস। ফলে গত কয়েক বছরে ডলার ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এ সব দিক বিবেচনা করে ডলারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। ভারতও তাদের বৈদেশিক ভান্ডারে ডলারের পরিমাণ আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছে। পরিবর্তে বৃদ্ধি পেয়েছে সোনা।
ডলারের পরিবর্তে কেন সোনাকেই বেছে নেওয়া হল? উত্তরটা সহজ। সোনা যে কোনও বৈদেশিক মুদ্রার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ সম্পদ। কারণ, মুদ্রার দামের উপর সোনার মূল্য নির্ভর করে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা এবং জোগানের উপর সোনার মূল্য নির্ভর করে। দামের ওঠাপড়াও হয় সেই অনুযায়ী। ফলে এই ধাতুতে বিনিয়োগ অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের বড় অংশ।
আরবিআইয়ের কাছে সঞ্চিত এই প্রায় ৮০০ টন সোনার মূল্য ৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। সোনার সঞ্চয় আরও বৃদ্ধি করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
২০২২-২৩ অর্থবর্ষে আরবিআই মোট ৩৪.২২ টন সোনা কিনেছে। তার আগের অর্থবর্ষে আরও বেশি সোনা কেনা হয়েছিল। ২০২১-২২ সালের মধ্যে প্রায় ৬৫.১১ টন সোনা কিনেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে আরবিআইয়ের মোট কেনা সোনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৮.৪১ টন। লক্ষণীয়, কোভিড অতিমারির সময়েই সোনা সঞ্চয়ে জোর দিয়েছে আরবিআই।
আরবিআইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, তাদের কাছে সঞ্চিত সোনার মধ্যে ৪৩৭.২২ টন সোনা তারা ভারতে রাখেনি। বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা আছে এই সোনা।
ব্রিটেনের ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডের ব্যাঙ্ক অফ ইন্টারন্যাশানাল সেটেল্মেন্ট (বিআইএস)-কে সংগৃহীত সোনা গচ্ছিত রাখার জন্য বেছে নিয়েছে আরবিআই।
আরবিআইয়ের গচ্ছিত মোট সোনার মধ্যে বাকি ৩০১.১০ টন রাখা হয়েছে দেশেই। ভারতের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে এই সোনা জমিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
শুধু আরবিআই নয়, বিশ্বের একাধিক কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক গত কয়েক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে সোনা জমিয়েছে। তালিকায় রয়েছে মনেটারি অথরিটি অফ সিঙ্গাপুর (এমএএস), পিপল্স ব্যাঙ্ক অফ চায়না (পিবিওসি) এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ দ্য রিপাবলিক অফ টার্কি।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০২ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চিন তাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে মোট ১ হাজার ৪৪৮ টন সোনা যোগ করেছে।