ভারতের ‘লোকসভা ভোটে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা’ করা হচ্ছে! নির্বাচন চলার সময় এক বিদেশি রাষ্ট্রের অভিযোগ ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
শুক্রবার সেই অভিযোগের জবাব দিতে মুখ খুলল অভিযুক্ত পক্ষও। যদিও গোটা ঘটনাপ্রবাহে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছে নয়াদিল্লি। কারণ, অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত— দুই দেশই ভারতের বন্ধু।
দুই দেশের সঙ্গেই রয়েছে ভারতের ঘনিষ্ঠ এবং কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। অভিযোগকারীর সঙ্গে অবশ্য ভারতের সম্পর্ক বেশ পুরনো। স্বাধীনতার পর থেকেই নানা আপদে-বিপদে সেই বন্ধু নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়িয়েছে।
আর নতুন বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা তুলনায় বেশ হাল আমলের। কিন্তু ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনা আগ্রাসনের মোকাবিলায় সেই বন্ধুর গুরুত্বও ভারতের কাছে কম কিছু নয়।
সম্প্রতি আমেরিকার বিরুদ্ধে ভারতের লোকসভা ভোটে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার অভিযোগ তোলে রাশিয়া। মস্কোর দাবি, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য নষ্ট করতে চাইছে ওয়াশিংটন।
ভারতে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা হ্রাস’ পাওয়া নিয়ে সম্প্রতি একটি রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমেরিকার ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’। এই রিপোর্ট নিয়েও আমেরিকাকে একহাত নিয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশাসন।
রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জ়াখারোভা সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেন, “ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ করে যাচ্ছে আমেরিকা। আসলে ভারতীয়দের মানসিকতা এবং ভারতের ইতিহাস পুরোপুরি জানে না আমেরিকা।” আমেরিকা আসলে ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে জটিল করতে চায় বলেও দাবি করা হয় মস্কোর তরফে।
রাশিয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে মুখ খুলেছে আমেরিকা। তাদের বক্তব্য, শুধু বন্ধু ভারত নয়, কোনও দেশের সাধারণ নির্বাচনেই নাক গলায় না তারা।
এই প্রসঙ্গে আমেরিকার বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার সংবাদমাধ্যমে বলেন, “আমরা ভারতের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছি না। নির্বাচনের যে ফলাফলই হোক, তা নির্ধারণ করবেন ভারতের নাগরিকেরাই।”
খলিস্তানপন্থী জঙ্গি নেতা গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুনকে ‘হত্যা করার ষড়যন্ত্র’ নিয়ে আমেরিকার একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন-দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সম্প্রতি টানাপড়েন দেখা যায়।
আমেরিকার ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, পন্নুন-হত্যার ছকে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ জড়িত। ভারত গোড়া থেকেই বিষয়টি অস্বীকার করে এসেছে।
কয়েক বছর ধরেই ভারতের বিরুদ্ধে তাদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আর এক শিখ জঙ্গি হরদীপ সিংহ নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘সম্ভাব্য যোগ’ খুঁজে পেয়েছেন। তা নিয়েও অটোয়ার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কে একটা ফাটল ধরেছে।
ঘটনাচক্রে, পন্নুন হত্যার ছক নিয়ে আমেরিকার যে অভিযোগ, তা খণ্ডন করে সরাসরি ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। সম্প্রতি এই বিষয়ে মুখ খুলে আমেরিকা জানিয়েছিল, ভারতের উচিত ‘অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে’ বিষয়টির তদন্ত করা।
রাশিয়ার অবশ্য বক্তব্য, পন্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করায় ভারতীয়দের যুক্ত থাকার যে অভিযোগ উঠছে, তা নিয়ে আমেরিকা এখনও কোনও ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ হাজির করতে পারেনি।
ঠান্ডা যুদ্ধের আগে থেকেই রাশিয়া ভারতের বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গী। একাধিক বার আমেরিকার চোখরাঙানির সামনে রাশিয়ার ভরসার হাত ভারতের সঙ্গে থেকেছে।
আবার চলতি শতাব্দীর গোড়া থেকেই ধাপে ধাপে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের মতো শক্তির প্রভাব কমাতে ভারতের গুরুত্ব টের পেয়েছে ওয়াশিংটনও।
তবে গত দু’বছরে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে রাশিয়া। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইউক্রেনের পাশে অর্থ এবং অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিম এশিয়াতেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে ইজ়রায়েল, প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস, ইরান। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে বিশ্বের দুই বৃহত্তর শক্তির সংঘাতের নয়া বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ভারত। ‘ভোটে হস্তক্ষেপ’ সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা থাক বা না-থাক, কূটনৈতিক পরিসরে এটা নয়াদিল্লির গুরুত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন অনেকে।