ফর্সা নয়, শ্যামলাও বলা যায় না। তাঁর গায়ের রং ছিল আদ্যোপান্ত কালো। কিন্তু সেই তামাটে বর্ণের মূল আকর্ষণ ছিল চোখের কোটরে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ চোখে যেন চুম্বকের আকর্ষণ।
কথা হচ্ছে রাধা আতিফকে নিয়ে। মলদ্বীপে জন্ম তাঁর। মডেলিংকে প্রাথমিক ভাবে কেরিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তবে মনে মনে অন্য স্বপ্ন বুনতেন রাধা।
রাধার স্বপ্ন ছিল, তিনি চিকিৎসক হবেন। মেধাবী ছাত্রী হিসাবে মলদ্বীপ থেকে বৃত্তি পেয়ে রাধা ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু সেখানেই ঘনিয়ে আসে মৃত্যু।
রাধার স্বপ্নপূরণ হয়নি। বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে মেলে তাঁর লাশ। প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যা বলে মনে হলেও এই মৃত্যুতে রহস্যের গন্ধ পান অনেকেই।
পেশায় মডেল রাধা মলদ্বীপের ছোট শহর থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন ভোগের ম্যাগাজ়িনে। তাঁর রূপ দেখে আন্তর্জাতিক ওই ম্যাগাজ়িনটি তাঁকে ডাকে। কভার পৃষ্ঠায় রাধার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল।
২০১৪ সালে রাধার মডেলিংয়ে হাতেখড়ি। মলদ্বীপের এক চিত্রগ্রাহকের সৌজন্যে কয়েকটি ফটোশুটের পর নিজের দেশে জনপ্রিয়তা পান রাধা। তার পর ২০১৬ সালে ভোগ থেকে তাঁর ডাক আসে।
রাধার অনুগামী এবং ঘনিষ্ঠজনেরা বলাবলি করতেন, কালো চামড়ায় স্ফটিকের মতো চোখ দু’টিই তাঁর চেহারার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এই বিপরীতধর্মী বর্ণ রাধার রূপে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল।
মলদ্বীপের উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে বৃত্তি পেয়েছিলেন রাধা। তিনি বাংলাদেশের রাজশাহিতে ইসলামি ব্যাঙ্ক মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। সেখানেই হস্টেলে থাকতেন।
২০১৭ সালের ২৯ মার্চ কলেজের হস্টেলের ঘর থেকে রাধার নিথর দেহ উদ্ধার হয়। দেহটি প্রথম দেখেন তাঁর বান্ধবী সিরত পারভিন মাহমুদ। রাধার সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন সিরত।
সিরত কাশ্মীরের মেয়ে। তিনিও বাংলাদেশে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। রাধার মৃত্যুর পর খুনের সন্দেহে তাঁর দিকে আঙুল উঠেছিল। সন্দেহভাজনদের তালিকায় প্রথম সারিতেই ছিলেন এই কাশ্মীরি তরুণী।
সিরতের বয়ান অনুযায়ী, রাধা ক্লাসে আসছেন না দেখে তিনি ঘরে তাঁকে খুঁজতে যান। কিন্তু ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। জানলা দিয়ে সিরত দেখতে পান, রাধা সিলিং থেকে ঝুলছেন।
সিরতই দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে রাধার দেহ নামিয়ে আনেন। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেন। শুরু হয় তদন্ত। প্রথম থেকেই কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, রাধা আত্মঘাতী হয়েছেন।
রাধার দেহের ময়নাতদন্ত করা হয় রাজশাহি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেই রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ হিসাবে আত্মহত্যার উল্লেখই করা হয়েছিল। উড়িয়ে দেওয়া হয় খুনের সম্ভাবনা।
রাধার বাবা মহম্মদ আতিফ কিন্তু প্রথম থেকেই দাবি করেছিলেন, তাঁর কন্যাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি নিজেও পেশায় চিকিৎসক। আতিফের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল বেশ কয়েকটি সন্দেহজনক তথ্য।
রাধার বাবা পুলিশকে জানান, এই মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে রাধা তাঁর মাকে ফোনে জানান, তাঁর বান্ধবী সিরত তাঁকে ফলের শরবত খেতে দিয়েছিল। তাতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল।
এ ছাড়া, মৃত রাধার গলার চারপাশে মানুষের আঙুলের ছাপ ছিল বলে দাবি করেন আতিফ। সিরত বলেছিলেন, তিনি দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকেন। কিন্তু দরজায় কোনও রকম আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। সেই তথ্য পুলিশের সামনে তুলে ধরেন মৃতার বাবা।
বিতর্কের মাঝে রাধার দেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও রহস্যের সমাধান হয়নি। রাধার পরিবারের অভিযোগ, রূপ এবং স্বতন্ত্রতার কারণেই তাঁদের মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে।
অভিযোগ, মুসলমান হয়েও মডেলিং করায় বাংলাদেশের কলেজে রাধাকে নানা ভাবে হেনস্থা করা হত। সহপাঠীদের কটু কথা প্রায়ই শুনতে হত তাঁকে। রক্ষণশীলরা অনেকেই নাকি মলদ্বীপের এই মডেলকে হুমকি দিতেন।
মাত্র ২০ বছর বয়সে মডেলিং কেরিয়ারে নজরকাড়া সাফল্য, রূপের ছটায় তাক লাগানো এই তরুণীর মৃত্যু রহস্য হয়েই থেকে গিয়েছে। অভিযোগ, তাঁর মৃত্যুর তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশও এ নিয়ে বেশি জলঘোলা করতে চায়নি।
রাজশাহিতেই কবরস্থ করা হয় মলদ্বীপের রাধাকে। বেঁচে থাকলে আন্তর্জাতিক মডেলিংয়ের দুনিয়ায় তিনি অন্যতম তারকায় পরিণত হতে পারতেন বলে মনে করা হয়। আচমকা মৃত্যু এসে সেই সম্ভাবনার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে।