উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে ‘হিরো’ হয়ে উঠেছে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’। এই পদ্ধতিতে সুড়ঙ্গের ধ্বংসস্তূপ খুঁড়েই আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা গিয়েছে। হার মেনেছে বিদেশি যন্ত্রও।
কিন্তু ভারতে এই বিশেষ খননপদ্ধতি নিষিদ্ধ। ২০১৪ সালেই আইন অনুযায়ী ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল। এই পদ্ধতিকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলেও দেগে দেওয়া হয়।
‘র্যাট-হোল মাইনিং’ যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তার প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এই পদ্ধতির খনন বার বার বিপদ ডেকে এনেছে। দেশের নানা প্রান্তে কয়লাখনিতে মৃত্যুর আর এক নাম হয়ে উঠেছে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’।
‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর সব থেকে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল মেঘালয়ে। পাঁচ বছর আগে উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিতে খনির ভিতরে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১০ জন শ্রমিক। নেপথ্যে ছিল ‘র্যাট-হোল’-এর মরণফাঁদ।
কী হয়েছিল মেঘালয়ে? ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় কয়লাখনিতে বিপর্যয় ঘটে। অভিযোগ, সেখানে বেআইনি ভাবে মাটি খুঁড়ে কয়লা উত্তোলনের কাজ চলছিল।
কয়লাখনিতে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ পদ্ধতিতে মাটি খুঁড়ে এগোচ্ছিলেন ১৫ জন শ্রমিক। শাবল-গাঁইতি দিয়ে ছোট ছোট গর্ত খুঁড়েছিলেন তাঁরা। আচমকা একটি দেওয়াল ঠুকতেই হু হু করে বেরিয়ে আসে জল।
ওই কয়লাখনিতে আগে থেকেই নিকটবর্তী লিটেইন নদীর জল ঢুকে ছিল। দেওয়ালের এ পারে শ্রমিকেরা তা বুঝতে পারেননি। দেওয়াল খুঁড়ে ফেলতেই জল এ পারে চলে আসে। ভেসে যায় খনির সুড়ঙ্গ।
সুড়ঙ্গে থাকা ১৫ জনের মধ্যে পাঁচ জন শ্রমিক কোনও রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি ১০ জন সুড়ঙ্গে আটকে পড়েন। জল থইথই সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনও পথ ছিল না।
সুড়ঙ্গে থাকা ১৫ জনের মধ্যে পাঁচ জন শ্রমিক কোনও রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি ১০ জন সুড়ঙ্গে আটকে পড়েন। জল থইথই সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনও পথ ছিল না।
শ্রমিকদের বাঁচাতে খনি থেকে জল ছেঁচে তোলা হয়েছিল। কিন্তু বাধ সাধে বৃষ্টি। জয়ন্তিয়া পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় ঠিক সেই সময়েই। ফলে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়। নদীও আবার ফুঁসে ওঠে। খনিতে ঢুকে পড়ে নদীর জল।
২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। শেষমেশ হার মানেন সেনাবাহিনীর জওয়ানেরাও। ২ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ধারকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ডিসেম্বরের শেষ দিকেই আন্দাজ করা গিয়েছিল ওই ১০ জন শ্রমিকের পরিণতি। খনির ভিতর থেকে পচা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল বলে দাবি ওঠে। সেগুলি মৃতদেহের কারণে কি না, তা স্পষ্ট না হলেও সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে চর্চা হয়।
সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের দেহও উদ্ধার করা যায়নি। দু’মাসের বেশি সময় ধরে চলা উদ্ধারকাজে মাত্র দু’জন শ্রমিকের দেহ মেলে। সেগুলি তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বাকিদের খোঁজ মেলেনি।
মেঘালয়ের এই কয়লাখনির দুর্ঘটনা নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়। সমালোচনা উঠে আসে নানা মহল থেকে। ২০১৪ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কেন ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ বন্ধ করা যায়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এ মূল ঝুঁকির কারণ হল, সুড়ঙ্গ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়। ফলে যে কোনও মুহূর্তে ধস নেমে শ্রমিকের মৃত্যু হতে পারে। সঙ্কীর্ণ পথে পালানোর কোনও পথ থাকে না।
ভারতীয় সেনার তরফে দাবি করা হয়েছিল, যে খনিতে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কোনও নকশা বা ‘ব্লু-প্রিন্ট’ ছিল না। সেই কারণে উদ্ধারকারীদের বিপুল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই সংক্রান্ত মামলার জল গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত।
উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে অবশ্য কাজে লেগেছে সেই বিতর্কিত ‘র্যাট-হোল মাইনিং’। যে কাজে কয়েক দিন লাগার কথা ছিল, সেই কাজ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সেরে ফেলেন বিশেষজ্ঞ খনি শ্রমিকেরা।
১৭ দিন পর উত্তরকাশীর বদ্ধ সুড়ঙ্গ থেকে শ্রমিকদের বার করে আনা সম্ভব হয়েছে ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর দৌলতে। এটি প্রাচীন পন্থা। একসময় খনির কাজে এই পন্থা অত্যন্ত প্রচলিত ছিল। তবে ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখে তা নিষিদ্ধ করা হয়।
মেঘালয় এবং অন্যান্য উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে অবশ্য এখনও বেআইনি খনন চলে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খনিতে নামেন শ্রমিকেরা। দারিদ্র যার মূল কারণ। উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সামর্থ্য নেই শ্রমিকদের।
উত্তরকাশীতে সাফল্য এলেও ‘র্যাট-হোল মাইনিং’-এর ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। তাই এই পদ্ধতি খনিতে কাজে না লাগানোরই পক্ষপাতী বিশেষজ্ঞেরা।