ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই। তার পর প্রায় দেড় মাস হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লড়াই। মঙ্গলবার থামল সেই লড়াই। ৫৬ বছর বয়সে প্রয়াত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী রাশিদ খান। বহু বছর আগের একট ঘটনা বদলে দিয়েছিল জীবন। সে দিনই রাশিদ স্থির করেছিলেন সঙ্গীতশিল্পীই হবেন তিনি। সেই লক্ষ্যও পূরণ হয়েছিল শীঘ্রই।
গত কয়েক বছর ধরে প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন শিল্পী। চিকিৎসা চলছিল। তাতে বেশ সুস্থই ছিলেন রাশিদ। চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের সুরসাধনা।
তার মাঝেই আচমকা ছন্দপতন। মস্তিষ্কে ‘ব্লিডিং’ (রক্তক্ষরণ) হওয়ার কারণে গত ২২ নভেম্বর দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল রাশিদকে।
ওই হাসপাতালেই মঙ্গলবার বিকেল ৩টে ৪৫ মিনিটে প্রয়াত রাশিদ। চিকিৎসক জানান, মাথায় ব্লিডিং (রক্তক্ষরণ) নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এত দিন হাসপাতালে থাকার ফলে সংক্রমণ হয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে তাঁকে ভেন্টিলেশনে পাঠাতে হয়েছিল। আর ফেরানো যায়নি শিল্পীকে।
চিকিৎসক যখন হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে শিল্পীর মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করছেন, তখন পাশে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। রাশিদের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাশিদ নেই ভেবেই তাঁর ‘গায়ে কাঁটা’ দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘ভাবতেই পারছি না, রাশিদ আর নেই। ওঁর মিষ্টি গলাটা আর শুনতে পাব না।’’
শিল্পীর সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক ছিল, সে কথাও তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘রাশিদ ছিল আমার ভাইয়ের মতো। খুব ভাল সম্পর্ক ছিল আমাদের। বাংলা উর্দু মিশিয়ে মিষ্টি করে কথা বলত। ও আমাকে বলত, ‘তুমি আমার মা আছ’।’’
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হাসপাতালেই রাখা ছিল মরদেহ। সেখান থেকে বেরিয়ে রাশিদের দেহ নিয়ে যাওয়া হয় পিসওয়ার্ল্ডে। রাতে দেহ থাকবে সেখানে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় রবীন্দ্র সদনে নিয়ে যাওয়া হবে দেহ। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন তাঁর অগণিত ভক্ত। দুপুর ১টায় কলকাতা পুলিশের তরফে গান স্যালুট দেওয়া হবে। তার পর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে শিল্পীর দেহ। সেখানে নিয়ম-আচার পালনের পর নিয়ে যাওয়া হবে টালিগঞ্জ কবরস্থানে। সেখানেই হবে শিল্পীর শেষকৃত্য।
১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম রাশিদের। তিনি রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিল্পী। যে ঘরানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খাঁ-সাহিব। রাশিদ তালিম নিয়েছিলেন এই ঘরানারই আর এক দিকপাল উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিবের কাছ থেকে। যিনি ছিলেন রাশিদের দাদু।
রাশিদ নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, দাদু নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব ছিলেন কড়া প্রকৃতির মানুষ। খুব রাগী। তাঁর সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পেতেন। রিয়াজে একটু ভুলচুক হলে সোজা চড়-থাপ্পড়! মূলত তাঁর ভয়েই রোজ নিয়ম করে রিয়াজ করতে বসতেন রাশিদ।
১৯৭৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব। সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (এসআরএ)-র গুরু হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১০-১১ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে বদায়ূঁ থেকে কলকাতা চলে এসেছিলেন রাশিদ।
সেই থেকে দাদুর কাছে গান শিখতে শুরু করেছিলেন রাশিদ। পরীক্ষা দিয়ে সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। তার পর থেকে গিয়েছিলেন কলকাতাতেই।
রাশিদের মামা গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের থেকেও তালিম নিয়েছিলেন রাশিদ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীই যে হবেন, তা স্থির করেছিলেন অনেক পরে। নেপথ্যে ছিল অন্য এক কাহিনি।
এক বার কলকাতার ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে ভীমসেন জোশীর গান ছিল। রাশিদ ভেবেছিলেন, খুব কাছ থেকে ভীমসেনের গান শুনবেন। মঞ্চের পাশে এক জায়গায় বসেছিলেন। সে সময় এক উদ্যোক্তা তাঁকে সেখান থেকে উঠে যেতে বলেন। সেই ঘটনা রাশিদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ভেবেছিলেন, ‘‘ঠিক আছে, আমি এক দিন এমন জায়গায় পৌঁছব যে, তোমাদের দৌড়তে হবে আমার পিছনে!’’
রাশিদের লক্ষ্যপূরণ হয়েছিল খুব শীঘ্রই। পরে সেই ডোভার লেড মিউজিক কনফারেন্সেই গান গেয়েছিলেন তিনি। ডোভার লেন থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য গিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। যে দিন ডোভার লেনে অনুষ্ঠান, তার আগেই প্যারিসে রাশিদের অনুষ্ঠান। রাশিদ সেই অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘‘আপনারা যদি প্যারিস থেকে আমাকে উড়িয়ে আনতে পারেন, তা হলে আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে গাইব।’’
প্রথম বার তাঁর গান শুনে খোদ ভীমসেন জোশী বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তার ভবিষ্যৎ পেয়ে গিয়েছে।’’ মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইলেও ফিউশন, হিন্দি এবং বাংলা ছবিতে বহু গান গেয়েছিলেন শিল্পী, যা জনপ্রিয় হয়েছিল।
অনুশীলন বা ‘রিয়াজ’ তো তাঁর ছিলই। পাশাপাশি, আবেগকেও নিজের গানে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন রাশিদ। অতীতে একটি সাক্ষাৎকারে রাশিদ এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘জীবনের যে ছোট ছোট দুঃখ, অপ্রাপ্তি— সেই সব রং আমি গানের মধ্যে আনার চেষ্টা করি।’’ আজ সেই রং মলিন। স্তব্ধ হয়েছে কণ্ঠ। অনন্ত সুরলোকের পথে পাড়ি দিয়েছেন শিল্পী। রেখে গিয়েছে সুর-শিল্প।