প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে অনেকেই নিজের উপাস্য দেবতাকে স্মরণ করেন, প্রার্থনা জানান। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস প্রায়ই এক জনকে প্রতিকূলতার মুখে সাহস জোগাতে সাহায্য করে। শোনা যায়, সে রকমই এক বার ঈশ্বরের দ্বারস্থ হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনার ডাকে নাকি ‘সাড়া’ও দিয়েছিলেন তিনি।
এই কাহিনি রাজস্থানের লোঙ্গেবালা সীমান্তের তনোট মন্দিরের। কথিত আছে, স্থানীয় দেবী তনোট (যিনি আওয়াদ মাতা নামে পরিচিত)-এর কৃপায় পাকিস্তানি বোমা ওই মন্দির এবং সংলগ্ন এলাকার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। মন্দির চত্বর এবং আশপাশে আছড়ে পড়া একটি বোমাও নাকি ফাটেনি। স্থানীয়দের দাবি, দেবী তনোটের কৃপায় ১৯৬৫ এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাক সেনাকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল ভারতীয় সেনা।
রাজস্থানের জয়সলমের শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে তনোট দেবীর মন্দির রয়েছে। বহু বছর ধরেই মন্দিরটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র।
তনোট হল রাজস্থানের ভারত-পাক সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। দেবী তনোটের নামেই এই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। কথিত আছে, দেবী হিংলাজের একটি রূপ দেবী তনোট। পরে তিনি কর্ণী মাতার রূপ ধারণ করেন। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজস্থানে তনোট দেবীর মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় রাজস্থান সীমান্তে পাকিস্তানি হামলায় প্রথম দিকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের গোলাবারুদের জবাব দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারতীয় সেনার কাছে ছিল না।
পাকিস্তানি বাহিনী এই সুযোগ নিয়ে সাদেওয়ালা পোস্টের কাছে কিষাণগড়-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়েছিল। ওই এলাকায় থাকা ভারতীয় সেনারা একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল।
সেই সময় ভারতের ১৩ গ্রেনেডিয়ার বাহিনীর সেনারা নিজেদের সেনাঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে লাগাতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল সাদেওয়ালায়। ১৭ নভেম্বর সাদেওয়ালায় তনোট দেবীর মন্দিরের কাছে একটি সেনাঘাঁটিতে হামলা চালাতে শুরু করে পাক সেনা। হামলার সময় বোমাগুলির বেশ কয়েকটি মন্দিরের আশপাশে এসে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে একটি বোমাও ফাটেনি।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৭ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত তনোট মন্দিরের আশপাশে প্রচুর বোমা ফেলেছিল পাক সেনা। এ-ও কথিত আছে যে, দেবী নাকি নিজেই ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্বপ্নে এসে দেখা দিয়েছিলেন এবং মন্দিরের কাছে থাকলে তাদের প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করার পর তনোট মন্দিরের দায়িত্ব নেয় বিএসএফ। বিএসএফ মন্দির চত্বরে একটি ঘাঁটি তৈরি করে এবং মন্দিরের পুজোর দায়িত্ব নেয়। এখনও পর্যন্ত মন্দিরটি বিএসএফ দ্বারা পরিচালিত হয়।
১৯৭১ সালেও নাকি ‘চমৎকার’ করেছিলেন তনোট দেবী। ’৭১-এর যুদ্ধে পাক সেনা সাদেওয়ালার পরিবর্তে লোঙ্গেবালা ঘাঁটিতে হামলা করে। এই ঘাঁটিটিও মন্দিরের কাছেই ছিল। মেজর কুলদীপ সিংহ চাঁদপুরীর নেতৃত্বে ১২০ জন সেনা লোঙ্গেবালা ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছিলেন।
বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ওই ঘাঁটির সেনারা দেবী তনোটের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছিল। ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের একটি পূর্ণ ব্যাটালিয়ন এবং সাঁজোয়া গাড়ি লোঙ্গেবালা ঘাঁটিতে হামলা চালায়। কিন্তু সে বারেও নাকি পাক সেনার ছোড়া একটি বোমাও ফাটেনি। উল্টে মুষ্টিমেয় ভারতীয় জওয়ানের কাছে পরাজিত হয় বিশাল পাক সেনা।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে তনোট দেবী এবং মন্দিরের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মন্দিরের ভিতরে একটি জাদুঘর তৈরি করে বিএসএফ। আরও বড় করে নির্মাণ হয় মন্দিরটির।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৯৬৫ এবং ’৭১-এর যুদ্ধে মন্দিরের আশপাশে নাকি তিন হাজারেরও বেশি বোমা ফেলা হয়েছিল। কিন্তু একটা বোমাও ফাটেনি। মন্দির চত্বরের ভিতরে বিএসএফ নির্মিত জাদুঘরে সেই বোমাগুলির কয়েকটি এখনও রাখা আছে।
লোঙ্গেবালার জয়কে চিরস্মরণীয় করে রাখতে মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বিজয়স্তম্ভ তৈরি করেছিল ভারতীয় সেনা। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় উদ্যাপন করতে মন্দিরের বাইরে আনন্দে মেতে ওঠে ভারতীয় সেনা।
১৯৭১ সালে লোঙ্গেবালা সীমান্তে ভারত-পাক সেনার সংঘাতের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত বলিউড ছবি ‘বর্ডার’। কী ভাবে ওই সীমান্ত এলাকায় ১২০ জন ভারতীয় সেনা দু’হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি সেনাকে পরাস্ত করেছিল, তা এই ছবিতে দেখানো হয়েছিল। সেই ছবিতেও তনোট দেবীর উপর সেনার ভরসার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছিল।