সত্তরের দশকে ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে শিপিং সংস্থা খুলেছিলেন জিয়ানলুইগি আপোন্তে। ব্যবসার সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী রাফায়েলা। পুঁজি বলতে দু’জনের কাছে ছিল ঋণ নেওয়া ২ লক্ষ ডলার। এবং অবশ্যই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস।
পাঁচ দশক আগে প্রথম বার ব্যবসা করতে নেমে একটি ছোট জাহাজ কিনেছিলেন রাফায়েলারা। তার পর থেকে ব্যবসা বাড়াতে একের পর এক জাহাজ কিনেছেন তাঁরা। বাণিজ্যিক জাহাজ ছাড়াও প্রমোদতরীর ব্যবসাও শুরু করেন।
‘আলফালাইনার’ নামে শিপিং ইন্ডাস্ট্রির পরিসংখ্যান প্রদানকারী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, রাফায়েলাদের সংস্থা মেডিটেরিনিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি)-র কাছে এই মুহূর্তে ৭৩০টি জাহাজ রয়েছে। সেগুলিতে ৪৮ লক্ষ কন্টেনার রাখার জায়গা আছে।
রাফালেয়াদের সংস্থার সদর দফতর রয়েছে সুইৎজ়ারজ্যান্ডের জেনিভায়। সেখান থেকেই এমএসসির যাবতীয় কাজকর্মের রাশ ধরে রেখেছেন রাফায়েলা এবং জিয়ানলুইগি। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এমএসসিতে কোনও পদে নেই রাফায়েলা। তবে তিনিই নাকি এই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অন্যতম ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’।
আমেরিকার এক সংবাদমাধ্যমের দাবি, গত বছরের গোড়ায় যখন জাহাজের ভিড়ে তিলধারণের স্থান ছিল না লং বিচ এবং ক্যালিফোর্নিয়া বন্দরে, সে সময় পণ্য পরিবহণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিপিং সংস্থাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল এমএসসি।
কন্টেনারে করে মালপত্র বহনের নিরিখে এই মুহূর্তে নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিপিং কোম্পানি রাফায়েলাদের সংস্থা। নিজের সংস্থার পাশাপাশি, আরও একটি নজির গড়ে ফেলেছেন ৭৮ বছরের এই বৃদ্ধা। আমেরিকার একটি পত্রিকার বিচারে, একক প্রচেষ্টায় ব্যবসা দাঁড় করিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মহিলার তকমা জিতে নিয়েছেন রাফায়েলা।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে মেয়ার্স্ক নামে ডেনিশ বহুজাতিককে ছাপিয়ে জাহাজ ব্যবসার শীর্ষে উঠে আসে এমএসসি। নিজেদের সম্পত্তির খতিয়ান প্রকাশ্যে আনেননি রাফায়েলারা। তবে শিপিং ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞ জন ম্যাককাউনের মতে, জিয়ানলুইগি এবং রাফায়েলার কাছে চলতি বছর ৩,১২০ কোটি ডলার করে সম্পত্তি রয়েছে। গত বছর দু’জনের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৮৪০ কোটি ডলার।
অতিমারি পর্বে অন্য অনেক ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলেও গোটা বিশ্ব জুড়েই শিপিং ইন্ডাস্ট্রি মুনাফা করেছিল। এর ফায়দা লুটেছিলেন রাফায়েলারা। কন্টেনার শিপিং ছাড়াও এমএসসির মালবাহী জাহাজ, প্রমোদতরী, কন্টেনার টার্মিনাল ব্যবসাও ফুলেফেঁপে ওঠে।
আমেরিকার একটি পত্রিকা জানিয়েছে, এমএসসিতে ৫০ শতাংশ করে শেয়ার রয়েছে রাফায়েলা এবং তাঁর স্বামীর। চলতি বছরে ধনকুবেরদের তালিকায় রাফায়েলাকে তারা রেখেছে ৪৩ নম্বরে। এর আগে কোনও সংস্থার মহিলা প্রতিষ্ঠাতা নাকি তাদের তালিকায় এত উঁচুতে জায়গা করে নিতে পারেননি।
ওই পত্রিকার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, একক প্রচেষ্টায় ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ধনকুবের হয়েছেন এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মোটে ৩.৬ শতাংশ মহিলা। রাফায়েলা তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাম।
ব্যবসায়িক উত্থানের মতোই রাফায়েলার ব্যক্তিজীবনও কম আকর্ষণীয় নয়। ষাটের দশকে ইটালির ক্যাপ্রি দ্বীপে ছুটি কাটাতে গিয়ে জিয়ানলুইগির সঙ্গে প্রথম দেখা তাঁর। সে সময় একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন জিয়ানলুইগি। নেপলস থেকে সান্তাঞ্জেলোর মতো ছোট শহরে জাহাজে করে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর।
ইজরায়েলি ব্যাঙ্কারের মেয়ে রাফায়েলার পারিবারিক বাড়ি ছিল সুইৎজ়ারল্যান্ডে। ইটালিতে প্রথম দেখার পর তাঁর জন্য জাহাজের চাকরি ছেড়ে জেনিভা পাড়ি দেন জিয়ানলুইগি। সেখানকার একটি ব্যাঙ্কে ব্রোকার হিসাবে কাজ শুরু করেন।
১৯৭০ সালে ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দেন জিয়ানলুইগি। তত দিনে রাফায়েলার সঙ্গে সংসার পেতেছেন তিনি। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সে বছরই এমএসসি প্রতিষ্ঠা করেন। ২ লক্ষ ডলার ঋণ নিয়ে ‘প্যাট্রিসিয়া’ নামে ছোট জাহাজ কিনে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তাঁরা।
গোড়ার দিকে পুরনো জাহাজ কিনে ব্যবসা বাড়ানোয় মন দিয়েছিলেন আপোন্তে দম্পতি। ধীরে ধীরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় তাঁদের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ১৯৭৯ সালে এমএসসির কাছে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৭টি।
এই মুহূর্তে এমএসসির এগ্জ়িকিউটিভ চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন জিয়ানলুইগি। ছেলে দিয়েগো সংস্থার প্রেসিডেন্ট। তবে ব্যবসার খুঁটিনাটি সামলানো থেকে শুরু করে বোর্ডের সদস্য হিসাবে নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেও নিজেকে কোনও পদে বেঁধে রাখেননি রাফায়েলা।
আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও পদে না থাকলেও এমএসসিতে রাফায়েলার সিদ্ধান্তই শেষ কথা। এমনই দাবি করেছেন ডমিনিক দেনাত। সত্তরের দশকে যাঁর কাছ থেকে ২ লক্ষ ডলার ধার করে প্রথম ব্যবসা শুরু করেছিলেন রাফায়েলারা। ডমিনিকের কথায়, ‘‘রাফায়েলা অত্যন্ত কড়া ধাতের মহিলা।’’