ভারতে যখন বৈদিক যুগের সবে শুরু, মুনি-ঋষিরা মন্ত্র-তন্ত্র-যজ্ঞে মন দিয়েছেন, জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠতে শুরু করেছে বেদচর্চার আশ্রম, ঠিক সেই সময়ে অন্য এক ‘অভিজাত’ সভ্যতা গড়ে উঠছিল ভারতের খুব কাছেই।
তখনও এ দেশে লৌহযুগ শুরু হয়নি। সবে অস্তিত্ব মিটেছে সিন্ধু সভ্যতার। প্রস্তর যুগ পেরিয়ে ব্রোঞ্জ যুগের শেষ পর্যায়ে রয়েছে ভারতের উত্তর ভাগ। ভারতীয় সীমানার কাছে সেই ‘অভিজাত’ সমাজেও তখন ভরপুর ব্যবহার ব্রোঞ্জের।
নাম বেগাজি ডান্ডিবাই সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০ শতকে এই সভ্যতার পত্তন। তবে পতনও হয়েছিল ২০০ বছরের মধ্যেই।
কিন্তু ওই কয়েকশো বছরেই বেগাজি ডান্ডিবাইয়ে তৈরি হয়েছিল রাজা, ধনী, ব্যবসায়ী, পুরোহিত, জ্ঞানী মানুষের এক উচ্চ স্তরের সমাজ।
সম্প্রতি ওই সমাজের উঁচু স্তরের প্রতিনিধিদের সমাধিস্থলের খোঁজ পেয়েছেন নৃতত্ত্ববিদেরা। সেই সমাধিস্থল থেকেই উঠে এসেছে একের পর এক অজানা তথ্য। প্রকাশ্যে এসেছে অজানা এক সভ্যতার জীবনযাপনের ধারা এবং সংস্কৃতির কথা।
প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো ওই সমাধিস্থলটি উদ্ধার করে চমকে গিয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। কারণ সমাধিস্থলটি ছিল একটি ছোটখাটো পিরামিড।
মায়া সভ্যতার সিঁড়ি দেওয়া পিরামিডের ছবি দেখেছেন কখনও। মেক্সিকোয় এমন অনেক সিঁড়ি-পিরামিড বা স্টেপ পিরামিডের দেখা মেলে। যা তৈরি করেছিলেন সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা মায়া সভ্যতার মানুষেরা। বেগাজি-ডান্ডিবাই সভ্যতার পিরামিডকেও দেখতে হুবহু সেই সিঁড়ি পিরামিডের মতো।
উচ্চতায় সামান্য খাটো। কিন্তু আকারে নেহাত কম নয় বেগাজি-ডান্ডিবাইয়ের এই পিরামিড। জমি থেকে এর উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট হলেও দৈর্ঘে ৯৮ ফুট এবং প্রস্থে ৬৫ ফুট বিস্তৃত পিরামিডটি।
গবেষকেরা পিরামিডের ভিতরে প্রবেশ করে দেখেছেন সেখানে পাথরের শবাধারে সার দিয়ে রাখা দেহ। তাঁদের দাবি, এই পিরামিড আসলে তৈরি করা হয়েছিল ওই সভ্যতার অভিজাত এবং উচ্চস্তরীয়দের সমাধিস্থ করার জন্য।
প্রত্যেক শবাধারের ভিতরে ছিল ব্রোঞ্জের অস্ত্র, মাটির পাত্র এবং পশু-পাখির হাড়গোড়ও। এ থেকে সে যুগের আধ্যাত্মিক ভাবনাচিন্তারও আভাস পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদদের ধারণা, বেগাজি-ডান্ডিবাই সভ্যতাতেও তন্ত্র-মন্ত্র সাধনার চল ছিল।
করাগন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ইতিহাস গবেষকেরা খনন করছিলেন কাজাখাস্তানের স্তেপ অঞ্চলে। টাল্ডি নদীর তীরে। সেখানেই ৩০০০ বছরের পুরনো এই পিরামিডটি আবিষ্কার করেন তাঁরা।
এই পিরামিড খুঁজতে গিয়ে সেই যুগের কাজাখস্তানে তৈরি হওয়া এক সুপরিকল্পিত শহরের তথ্য-প্রমাণও হাতে আসে গবেষকদের।
সে যুগে ১৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল সেই শহর। শহর জুড়ে ছিল প্রশস্ত রাস্তার জাল। সেই রাস্তা কোথাও কোথাও আবার গোলকধাঁধার মতো। শহরের সেই গোলকধাঁধায় প্রবেশের জন্য ছিল এক বিশাল তোরণও।
এ ছাড়াও ছিল পরিকল্পিত জলনিকাশি এবং জল সংগ্রহের ব্যবস্থা। ছিল উপাসনাস্থল, এমনকি বলি দেওয়ার বেদীও।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, এই শহরের বাসিন্দারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও পেশায় যুক্ত ছিলেন। তবে মূলত ধাতু শিল্প এবং বাণিজ্যেই এঁদের আগ্রহ ছিল বেশি।
সে যুগে ধাতু বলতে ছিল ব্রোঞ্জ আর তামা। বেগাজি-ডান্ডিবাই সভ্যতার মানুষজন সেই ধাতু বিক্রি করতেন দেশবিদেশে। সে যুগে বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে এই সভ্যতার অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের প্রমাণও পেয়েছেন গবেষকেরা। গোটা ইউরেশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল সেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক। গবেষকেরা বলছেন, পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে আকরিক সোনা খননের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।
তবে এই সভ্যতায় পশুজাত পণ্যের পেশাও প্রচলিত ছিল। সমাজে উচ্চ-নীচ ভাগও ছিল। ধাতু শিল্পের পেশায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজের অভিজাত স্তরে উত্থান হয়েছিল।
তবে এই সভ্যতার পুরোটাই অজানা থেকে যেত, যদি না কারাগন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকেরা এ নিয়ে গবেষণা শুরু করতেন। ৩০০০ বছরের পুরনো সভ্যতা মাটির নীচে ঢাকা পড়েই থেকে যেত আরও কয়েকশো বছর।