গাঢ় বেগনি রঙের জ্বলজ্বলে পাথর। আকারে খুব বড় নয়। তবে একরত্তি পাথরের ‘গুণ’ অনেক। এই পাথরের গায়ে নাকি লেগে আছে অনেক হতাশা আর মৃত্যুর গ্লানি।
বেগনি নীলাটি ‘দিল্লির নীলা’ নামে পরিচিত। তবে এর উৎপত্তি কানপুরে। শোনা যায়, কানপুরের একটি ইন্দ্রমন্দির থেকে নীলাটি চুরি গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৬৬ বছর আগে।
১৮৫৭ সাল। ভারতের একাংশ তখন সিপাহি বিদ্রোহে উত্তাল। ব্রিটিশ সরকার যে বিদ্রোহে প্রথম খানিক টলে গিয়েছিল। সেই উত্তাল রাজনৈতিক এবং সামাজিক আবহে বেগনি রঙের নীলাটি চুরি যায়।
ব্রিটিশ বাহিনীর ঘোড়সওয়ার সৈনিক ছিলেন ডব্লিউ ফেরিস। ১৮৫৭ সালে কানপুরের ইন্দ্রমন্দির থেকে তিনি বেগনি নীলাটি চুরি করেছিলেন বলে শোনা যায়।
মূল্যবান পাথরটি নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন ফেরিস। তার পরেই শুরু হয় নীলার ‘লীলাখেলা’। পাথরটি চুরি করার পর থেকে নাকি এক দণ্ডও শান্তি পাননি ফেরিস।
অর্থনৈতিক দিক থেকে ফেরিস এবং তাঁর পরিবারের উপর নেমে আসে চরম দুর্ভাগ্যের ছায়া। একের পর এক অর্থনৈতিক ক্ষতি তাঁদের কার্যত পথে বসিয়ে দিয়েছিল।
ফেরিসের পরিবারের অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন এই সময়। আপনজনদের হারাতে হয়েছিল ওই ব্রিটিশ সৈনিকদের। তাঁর বাড়ির এক কোণে চুপিসাড়ে পড়ে ছিল নীলাটি।
প্রথমে এই খারাপ সময়কে ভাগ্যের ফের বলেই মনে করেছিলেন ফেরিস। হঠাৎই তাঁর নজর পড়ে ভারত থেকে আনা পাথরটির উপর। তাঁর মনে হয়, ওই পাথর আনার পর থেকেই তাঁর দুর্ভাগ্যের সূত্রপাত।
বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য এক কাছের বন্ধুকে নীলাটি কিছু দিনের জন্য ধার দেন ফেরিস। পাথরটি পাওয়ার পর পরই নাকি অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেন সেই ব্যক্তি।
ভারত থেকে আনা বেগনি নীলার ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে ফেরিসের আর তখন কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি অবিলম্বে পাথরটি নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেন। তবে ‘দুঃখ-পাথরের’ গল্প এখানেই শেষ নয়।
১৮৯০ সাল নাগাদ নীলাটি ব্রিটিশ লেখক তথা বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড হেরন-অ্যালেনের কাছে যায়। নীলার ‘অভিশাপে’ দুর্ভাগ্য নেমে আসে তাঁর জীবনেও।
হেরন জানান, নীলাটি হাতে পাওয়ার পর থেকে তাঁর সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে খারাপ ঘটনা ঘটে চলেছে। কিছুতেই তিনি ভাগ্য অনুকূলে ফেরাতে পারছেন না।
হেরনও এক বন্ধুকে নীলাটি দিয়েছিলেন। দেখা যায়, তাঁর সঙ্গেও একের পর এক খারাপ ঘটনা ঘটেছে। বন্ধুটি হেরনের কাছে পাথরটি আবার ফিরিয়ে দেন। সাময়িক বিরতির পর আবার হেরনের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
অতিষ্ঠ হয়ে হেরন নীলাটি খালের জলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস পর সেখান থেকে বেগনি রঙের পাথরটি তুলে স্থানীয় স্বর্ণকারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নীলার আংটি ফিরিয়ে দেন হেরনের ঘরে।
আবার কিছু দিন নিজের কাছে নীলাটি রাখার পর হেরন অন্য এক বন্ধুর অনুরোধে সেটি তাঁকে দিয়ে দেন। সেই বন্ধু ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী। নীলাটি দেহে ধারণ করার পর থেকে আর কখনও তিনি গান করেননি।
নীলাটিকে নিয়ে এ বার তন্ত্রমন্ত্রের আশ্রয় নেন হেরন। পর পর সাতটি বাক্সে নীলাটি ভরে তিনি মন্ত্রের মাধ্যমে সেটিকে বন্দি করে রাখেন। পরিচিতদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরেও যেন বাক্স না খোলা হয়।
কিন্তু হেরনের মৃত্যুর পরেই বাক্স-সহ পাথরটি তাঁর কন্যা ব্রিটেনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে জমা দিয়ে এসেছিলেন। ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিউজিয়ামে থাকার পর বাক্সটি খোলা হয়।
হেরন বাক্সে একটি চিরকুট রেখে গিয়েছিলেন। তাতে তাঁর পরামর্শ ছিল, পাথরটি সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেওয়া উচিত। তবে তা করা হয়নি। কানপুরের ইন্দ্রমন্দিরের সেই বেগনি নীলা বর্তমানে ব্রিটেনের মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে।