নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে। চড়া রাজস্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ সঙ্কটের মুখে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের অসন্তোষ অনেক দিন ধরেই জমা হচ্ছিল। সেই জমা বারুদের বিস্ফোরণে তছনছ অবস্থা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে।
জম্মু-কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামি অ্যাকশন কমিটি (জেকেজেএএসি) নামে একটি স্থানীয় সংগঠনের মিছিল হওয়ার কথা ছিল শনিবার। কিন্তু তাঁর আগে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ মুজফ্ফরাবাদ ও মিরপুরে হানা দিয়ে ওই সংগঠনের বহু নেতাকে গ্রেফতার করে। তার প্রতিবাদে শুক্রবার উপত্যকায় হরতালের ডাক দেওয়া হয়। সেই হরতালকে কেন্দ্র করেও উত্তেজনা দেখা দেয় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে।
প্রতিবাদীদের মিছিল আটকাতে পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। দু’পক্ষের সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা।
কাঁদানে গ্যাস, ছররা থেকে বুলেট! আন্দোলন ঠেকাতে বাকি থাকেনি কিছুই। শূন্যে গুলি চালানোর পাশাপাশি জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগও উঠেছে। দফায় দফায় সংঘর্ষে একাধিক প্রতিবাদীর মৃত্যুর খবরও মিলেছে। তবে তাঁদের মৃত্যু পুলিশের গুলিতেই হয়েছে কি না তা নিশ্চিত নয়।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরে এ হেন অশান্তির ঘটনা নতুন নয়। প্রায়ই সেখানে কোনও না কোনও কারণ নিয়ে বিক্ষিপ্ত ঝামেলার ঘটনা ঘটে। খাদ্যসঙ্কট, মূল্যবৃদ্ধির মতো সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তান।
সেই সমস্যার আঁচ পড়েছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরেও। সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পাক সরকার তাঁদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে।
সবচেয়ে বেশি অশান্তি ছড়ায় পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট বাল্টিস্তান। সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশ বার বার ভারতের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সেই দাবিতে পথে নেমেছেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই যুব সম্প্রদায়।
২০১৯ সালে ভারতে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত হওয়ার পর থেকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে আন্দোলনের তেজ আরও বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, তার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদী সরকার পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর নিজেদের দাবি জোরদার করতে শুরু করেছেন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের মতো নেতারা বার বার দাবি করছেন, পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ। এমনকি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখেও ‘অখণ্ড ভারত’-এর কথা শোনা গিয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, পাক অধিকৃত কাশ্মীর কখনওই ভারতের বাইরের অংশ ছিল না। সেটি দেশেরই অংশ। ভারতীয় সংসদের একটি রেজ়োলিউশন রয়েছে, যাতে বলা আছে, পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ।
একই সুর শোনা গিয়েছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথের গলাতেও। তিনি জানিয়েছিলেন, ভারত পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে দখল না করলেও সেখানকার পরিস্থিতির জন্য ওই এলাকা শীঘ্রই ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরে এই ধারাবাহিক অশান্তিতে কি আখেরে ভারতেরই লাভ? সেই প্রশ্নই ঘুরে আসছে বার বার। অনেকের মতে, পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে পাক সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের জেরে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার ইচ্ছা আরও বৃদ্ধি পাবে।
২০২৩ সালে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে জম্মু ও কাশ্মীর সংরক্ষণ বিল এনেছিল কেন্দ্র। সেই বিলে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জন্যও জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় ২৪টি আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। বিল পেশের সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর আমাদেরই অংশ।’’
পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের বিরোধ বহু পুরনো। ভৌগোলিক দিক থেকে ওই অঞ্চলের দু’টি অংশ রয়েছে। একটি অংশ জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। আর উত্তর অংশ গিলগিট বাল্টিস্তান নামে পরিচিত। এটি লাদাখের পশ্চিম অংশের সঙ্গে যুক্ত।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের রাজা হরি সিংহ অনেক টালবাহানার পর ভারতের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, জম্মুর অমর প্রাসাদে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। এই চুক্তির ফলে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতীয় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
জম্মু ও কাশ্মীরের দখল নিয়ে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে দু’দেশের মধ্যে অশান্তি চলছে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীর নিয়ে সংঘাতের সূত্রপাত।
১৯৬৫ সালের অগস্ট মাস। শুধুমাত্র কাশ্মীর নয়, গুজরাতের কচ অঞ্চল নিয়েও সংঘাত তৈরি হয়। ১৯৭১ সালেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়ায়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা কার্গিল সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। মাস দুয়েকের ‘অপারেশন বিজয়’-এর পরে জয় পায় ভারত।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতে চিনকে বার বার ‘নাক’ গলাতে দেখা গিয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির একটি উপগ্রহচিত্র নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। সেই চিত্রে দাবি করা হয়, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের একাংশে বেআইনি ভাবে সড়ক তৈরি করছে চিন! যদিও সেই ছবির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে তৈরি হওয়া নতুন উত্তেজনা নিয়ে চাপে পড়েছে শাহবাজ় শরিফ সরকার। কী ভাবে প্রতিবাদীদের বিক্ষোভ প্রশমিত করা যায় সেই চিন্তাই শুরু হয়েছে পাক সরকারের মধ্যে।