অসন্তোষের আগুনে পুড়ছে চিন। সাধারণ নাগরিকের প্রশ্নের মুখে পড়ছে শি জিনপিং সরকার। চিনের সাধারণ মানুষকে সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে সাম্প্রতিক ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায়নি। যে সামান্য কয়েক বার চিনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনরোষ দেখানো হয়েছে, তা কড়া হাতেই দমন করেছে সে দেশের সরকার।
কিন্তু ইতিহাসে চিনের বিক্ষোভ দমনের ভয়াবহতার ইতিহাস জানা সত্ত্বেও কেন হঠাৎ করে সরকার-বিমুখ হয়ে পড়লেন সে দেশের সাধারণ নাগরিক? কেনই বা তোলা হল, ‘শি জিনপিং, ইস্তফা দাও’, ‘কমিউনিস্ট পার্টি গদি ছাড়ো’-জাতীয় স্লোগান।
চিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, সে দেশে আবার হু-হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। বাড়ছে আক্রান্ত এবং হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা। বিশ্ব জুড়ে কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পর আঙুল উঠেছিল চিনের দিকেই। আর তা জুড়ে তৈরি হয়েছিল একাধিক বিতর্কও। আর সেই কারণেই এ বার চিন যেন একটু বেশি সতর্ক। যেন আড়াই বছর আগে তৈরি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি তারা আর করতে চাইছে না।
কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা নতুন করে বৃদ্ধি পেতেই চিনের বিভিন্ন এলাকায় কঠোর লকডাউন আরোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ নিভৃতবাস এবং কোভিড পরীক্ষার করানোর রমরমা।
কোভিড যাতে কোনও ভাবেই ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেই লক্ষ্যে দেশ জুড়ে ‘কোভিড-শূন্য নীতি’র পথে হাঁটছে শি জিনপিং সরকার। দেশ জুড়ে কড়া কোভিড বিধির জন্য ঘরবন্দি সে দেশের বহু মানুষ। দৈনন্দিন কাজ করতেও অনুমতি নিতে হচ্ছে মানুষকে। কখনও অনুমতি মিলছে, আবার কখনও স্রেফ ‘না’ বলে ঘরের মধ্যেই থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
২০২০-’২১-এর অতিমারির আবহে দীর্ঘ দিন ঘরবন্দি হয়ে থাকতে থাকতে এমনিতেই বিরক্ত সাধারণ মানুষ। এই বছরেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় কার্যত চিনের সাধারণ মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে।
এর মধ্যেই সে দেশের নাগরিকদের অশান্তির আগুনে ঘি ঢেলেছে বৃহস্পতিবার উরুমকি শহরে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড।
সরকারি হিসাবে, সেই অগ্নিকাণ্ডেমৃত্যু হয়েছে দশ জনের। তবে অন্য অনেক মানুষের দাবি, সরকারের তরফে সত্যি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আসলে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কেবল কোভিড বিধির কারণেই উরুমকির বহুতলের আগুন নেভানোর কাজে দেরি হয়। কোভিডের কড়া বিধিনিষেধের কারণেই অনেক বাসিন্দা আবাসন ছেড়ে বেরোতে পারেননি বলেও অভিযোগ। যদিও স্থানীয় প্রশাসনের তরফে এই দাবি উড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসন জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর সঙ্গে লকডাউন বিধির কোনও সম্পর্ক নেই।
এই ঘটনার পরই রাস্তায় নামেন কাতারে কাতারে মানুষ। শুধু তাই নয়, বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে বেজিং এবং সাংহাইয়ের মতো বড় শহরগুলি থেকে, যে শহরগুলিকে বছরের প্রতিটি দিন বিশেষ নজরে রাখে সে দেশের সরকার।
সরকারের কোভিড নীতির প্রতিবাদে রবিবার রাজধানী বেজিংয়ে প্রতিবাদ করতে পথে নেমেছিলেন শ’য়ে শ’য়ে নাগরিক। আর পথে নেমে জিনপিং সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, কোনও ভাবেই আর ঘরবন্দি থাকতে রাজি নিন তাঁরা।
রবিবার বেজিং শহরের একটি নদীর ধারে প্রতিবাদ জানাতে অন্তত ৪০০ জন মানুষ জড়ো হয়েছিলেন বলে খবর। দীর্ঘ ক্ষণ তাঁরা বিক্ষোভ দেখান। ঘটনাস্থলে বিশাল পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। পরে বিক্ষোভকারীরা এলাকা ছেড়ে চলে যান।
বিক্ষোভ শুরু হয়েছে চিনের বাণিজ্য নগরী শাংহাইতেও। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। শাংহাইয়ের রাস্তায় সরকার বিরোধী নানান স্লোগান তুলতে শোনা গিয়েছে আন্দোলনকারীদের।
শনিবার গভীর রাত থেকে শাংহাইয়ের রাস্তায় জড়ো হন বিক্ষোভকারীরা। তবে এই ‘বেয়াদপি’ মেনে নেয়নি সরকারের পুলিশ। রবিবার সকালেই পুলিশ প্রতিবাদীদের সরিয়ে দেয়।
কিন্তু বেলা বাড়তেই আবার রাস্তায় নামে জনগণ। তবে এই প্রতিবাদে আওয়াজ-স্লোগান কিছুই ছিল না। নীরব প্রতিবাদকেই অস্ত্র করেন তাঁরা।
চিনের এই প্রতিবাদের বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—সরকারের কঠোর বিক্ষোভ দমন নীতি এবং চোখরাঙানি সম্পর্কে অবগত থেকেও কী ভাবে প্রতিবাদ করার ‘সাহস’ অর্জন করলেন সে দেশের মানুষ?
সম্প্রতি সে দেশের বৈগ্রহিক নেতা তথা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাও জে দংয়ের রেকর্ড ছুঁয়েছেন জিনপিং। মাওয়ের পর এই প্রথম কোনও চিনা প্রেসিডেন্ট টানা তিন বার ক্ষমতায় ফিরে এ্লেন। পার্টির সব থেকে উঁচুদরের কর্তা হিসেবেও রেকর্ড ছুঁয়েছেন শি।
মনে করা হচ্ছে, এই কারণেই জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। টানা প্রেসিডেন্টের পদে বসে জিনপিং-এর প্রভাবকে যেন একটু কম পাত্তা দিতে শুরু করেছেন দেশের মানুষ। আবার অনেকের মতে, সরকারে ফেরত এসে রেকর্ড গড়লেও তাঁর শাসননীতি নিয়ে সাধারণের একাংশের মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি ‘ভয়’ও কমতে শুরু করেছে।
শুধু শি নয়, মনে করা হচ্ছে মানুষের মনে প্রভাব কমেছে কমিউনিস্ট পার্টিরও। একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে সে দেশের সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে বলেও অনেকের মত। তাই সম্মিলিত আওয়াজ উঠেছে পার্টি এবং পার্টির সর্বময় কর্তার বিরুদ্ধে।
কিন্তু জনগণের মস্তিষ্কে বোধ হয় ঝাপসা হতে শুরু করেছে, ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন বিক্ষোভের স্মৃতি। এই প্রতিবাদকে নির্মম ভাবে দমন করেছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার।
মাও-পরবর্তী সময়ে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসতে শুরু করে। চিনের একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষ।
১৯৮৭ সালে সংস্কারপন্থী চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সাধারণ সম্পাদক হু ইয়াওবাং-এর মৃত্যুর সাধারণ মানুষ আরও সংগঠিত হন। এর পর ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংঘবদ্ধতার স্বাধীনতা, সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামেন সাধারণ মানুষ।
অনশন, ধর্মঘট, সরকার বিরোধী স্লোগানকে শক্তি করে পথে নামেন সে দেশের সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে তরুণ-যুব-পড়ুয়াদের ভিড়ই ছিল বেশি।
প্রথম দিকে সরকার এই বিক্ষোভকে হালকা ভাবে নিলেও পরে দমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেই দমননীতি ছিল অত্যন্ত নৃশংস। ১৯৮৯-এর ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে জড়ো হওয়া প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের উপর ট্যাঙ্ক দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এই ঘটনা প্রায় হাজারের উপর মানুষ মারা গিয়েছিলেন। আহতও হন হাজারো মানুষ। এই ঘটনা তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের গণহত্যা হিসাবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
সরকারের এই কড়া পদক্ষেপে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ধীরে ধীরে থেমে যায় আন্দোলনের রেশ।
তবে এই ঘটনায় অনেক চিনা সৈন্য মারা গিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির জেনেরাল সেক্রেটারি এবং পলিটব্যুরো সদস্য পদ থেকে সরে দাঁড়ান ঝাও জিয়াং।
১৯৯৯-এর ফালুন গং ধর্মসম্প্রদায়ের আন্দোলন ছাড়া এত বড় মাপের জনবিক্ষোভ চিনে আর দেখা যায়নি।
এর পর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জনরোষ চিনে দেখা গেলেও, সেগুলি সংগঠিত ছিল না। সংগঠিত হল আবার ২০২২-এ। তবে এখনও শান্তই রয়েছে সরকার। যেন দূর থেকে দেখছে জনগণের আস্ফালন।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, ইরানে মেয়েদের হিজাব-বিরোধী আন্দোলনের মতো চিনের সরকার বিরোধী আন্দোলনেরও মূল চালিকাশক্তি দেশের তরুণ-যুবদের দল। যার মধ্যে পড়ুয়াদের সংখ্যাই বেশি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও অসন্তোষের আগুন ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। চিনের অন্দরে অসন্তোষ শুরু হওয়ায় সে দেশের সরকারের পদক্ষেপ দেখতে বহির্বিশ্ব মুখিয়ে রয়েছে।