হামাস-ইজ়রায়েল সংঘাত থামার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি এখনও অবধি। বরং যুদ্ধের মাত্রা এবং ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।
বাইরের লড়াই যত তীব্র হচ্ছে, ততই যুযুধান দু’পক্ষের ঘরোয়া বাধ্যবাধকতার বিষয়টি নিয়ে চর্চা চলছে। বিশ্বের বহু দেশ, মানবাধিকার সংগঠন চলতি সংঘাত বন্ধের জন্য দু’পক্ষকে আর্জি জানালেও অনেকেরই আশঙ্কা যে, এই যুদ্ধ থামানো সহজ হবে না।
চলতি এই সংঘাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যুক্ত সব পক্ষেরই নির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রয়েছে ঘরোয়া রাজনীতিতে ‘মুখরক্ষা’ করার লড়াইও।
ইজ়রায়েলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যেমন কঠোর প্যালেস্তাইন-বিরোধী অবস্থানের জন্যই তাঁর সমর্থকদের কাছে জনপ্রিয়। ঘরোয়া রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রাখতে তাঁকে প্যালেস্টাইন-বিরোধী অবস্থানে শান দিয়ে যেতেই হবে।
তা ছাড়া, ঘরোয়া রাজনীতিতে খুব একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই নেতানিয়াহুও। সরকার গড়ার জন্য তাঁর লিকুদ পার্টিকে জোট বাঁধতে হয়েছে অতি দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে। সেই দলের অবস্থান আরও বেশি প্যালেস্তাইন-বিরোধী।
শরিকের মন জয় করতে প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে চাইলেও নরম অবস্থান নিতে পারবেন না ইজ়রায়েলি প্রেসিডেন্ট। তা ছাড়া নেতানিয়াহুর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর দেশেই কিছু দিন আগে পর্যন্ত ক্ষোভের আগুন জ্বলেছে।
ইজ়রায়েলের বিচারব্যবস্থায় সংস্কার করে বিচারবিভাগের ঊর্ধ্বে শাসনবিভাগকে ঠাঁই দিতে পার্লামেন্টে বিল পাশ করায় নেতানিয়াহু সরকার। এই বিতর্কিত বিল নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ইজ়রায়েলবাসীর একটি বড় অংশ।
রাজধানী তেল আভিভ তো বটেই, ইজ়রায়েলের একাধিক জায়গায় বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন প্রতিবাদকারীরা। প্রস্তাবিত বিল নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করে ইজ়রায়েল-বন্ধু আমেরিকাও। নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করার অভিযোগ ওঠে।
তার মধ্যেই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ঘরোয়া এই চাপের মুখে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই নেতানিয়াহুকে রাজনৈতিক ভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে এই সম্ভাবনা নিয়েও হরেক সংশয় আছে। কারণ যে ভাবে হামাস বাহিনী অতর্কিতে ইজ়রায়েলিদের উপর হামলা চালিয়েছে, তার পর গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে নেতানিয়াহু সরকারকে।
বাইরের চাপের সঙ্গে ঘরের চাপে জর্জরিত হামাসও। বিশ্বের বহু দেশ এখনও পর্যন্ত প্যালেস্তিনীয়দের বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে প্যালেস্তানিয়ান অথোরিটি (পিএ)-কেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এই পিএ শাসনকার্য পরিচালনা করে রামাল্লা থেকে।
ইজ়রায়েলি আগ্রাসানের বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল হামাস। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে কোনও ‘উপযুক্ত’ পদক্ষেপ করতে না পারার জন্য তাদের জনসমর্থনেও নাকি ভাটার টান দেখা দিচ্ছিল।
এক সময় প্যালেস্তাইনের হয়ে ইজ়রায়েল এবং পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে দর কষাকষির কাজটা করতেন পিএলও প্রধান ইয়াসের আরাফত। কিন্তু খাস প্যালেস্তাইনেই ক্রমশ রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকেন তিনি। অন্য দিকে চরমপন্থী হিসাবে পরিচিত হামাসও যদি চরম অবস্থান ধরে রাখতে না পারে, তবে তাদের প্রাসঙ্গিকতা কমতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।
আরব-ইজ়রায়েল দীর্ঘ সংঘাতে চরমপন্থীরা বহু বার রাজনৈতিক সাফল্য পেয়েছেন। অন্য দিকে রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা হতে হয়েছে দু’পক্ষের আলোচনাপন্থীদের।
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন আরব-ইজ়রায়েল সংঘাতে লাগাম পরাতে মুখোমুখি বৈঠকে বসিয়েছিলেন ইজ়রায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়াৎজ়াক রবিন এবং প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশন (পিএলও) প্রধান ইয়াসের আরাফতকে। কিন্তু রবিনকে খুন হতে হয় নিজের দেশেই।
বলা হয় যে, রবিনের প্যালেস্তাইনের প্রতি নরম অবস্থান মেনে নেননি অনেকেই। আবার প্যালেস্তাইনেও আরাফতের তুলনায় নরম পথ মেনে নেননি অনেকেই। পিএলও-র জায়গায় এসেছে হামাস— যারা ইজ়রায়েল রাষ্ট্রটাকেই বিলোপ করার পক্ষপাতী।
কিছু দিন আগে আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইজ়রায়েলের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছিল অন্যতম আরব রাষ্ট্র সৌদি আরব। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, সৌদি আরবের মতো দেশ ইজ়রায়েলের সঙ্গে আলোচনায় বসলে প্যালেস্তাইনের হয়ে লড়াই আরও দুর্বল হয়ে পড়ত। হামাস লড়াইয়ে নেমে এই সম্ভাব্য বোঝাপড়া রুখতে চেয়েছে।
আবার আপাত নিরপেক্ষতা ছেড়ে ক্রমে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর শব্দ প্রয়োগ করছে সৌদি আরবও। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি সংঘাতের আবহে ইজ়রায়েলের প্রতি নরম অবস্থান নিয়ে দেশবাসীর বিরাগভাজন হতে চাইছেন না সৌদি কর্তৃপক্ষ।
তাই ক্রমে ইরানের সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়িয়ে চলেছে সৌদি। সম্প্রতি দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে ফোনে কথাও হয়েছে। ইরান আবার চরম ইজ়রায়েল-বিরোধী অবস্থানেই শান দিচ্ছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে সৌদি-ইরান কাছাকাছি আসা ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকেই।