মধ্যপ্রদেশে গেরুয়া ঝড়। সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল আসনে জিতে জয় হাসিল করেছে পদ্ম শিবির। ২৩০ আসনের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় জয়ের জাদুসংখ্যা ছিল ১১৫। অনায়াসে তা অতিক্রম করে ফেলেছে বিজেপি। জয় এসেছে ১৬৩টিতে। বিরোধী কংগ্রেস জয় পেয়েছে মাত্র ৬৬টি আসনে।
২০০৩ সাল থেকে মধ্যপ্রদেশকে নিজেদের হাতেই রেখেছে বিজেপি। ২০১৮ সালে বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে গদিচ্যুত করে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশে সে বছর কংগ্রেস পেয়েছিল ১১৪ আসন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বিজেপি জিতেছিল ১০৯টি আসন।
তবে শেষরক্ষা হয়নি কংগ্রেসের। দেড় বছরের মাথায় জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডের সাহায্যে কংগ্রেসের দু’ডজন বিধায়ক ভাঙিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের সরকার ভেঙে দিয়েছিল বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হন বিজেপির শিবরাজ সিংহ চৌহান।
সেই শিবরাজের হাত ধরেই ২০২৩-এর নির্বাচনে আবার মধ্যপ্রদেশের সিংহাসনে ফিরেছে বিজেপি। তবে সে রাজ্যে বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ের পর সকলের কাছে একটাই প্রশ্ন—কে বসছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে?
মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনের জিতলে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা আগে থেকে ঘোষণা করেনি বিজেপি। বিষয়টিকে গেরুয়া শিবিরের নির্বাচনী রণকৌশল হিসাবেই মনে করা হচ্ছে। ভোটপণ্ডিতদের একাংশের দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তাকে সামনে রেখে মধ্যপ্রদেশে নির্বাচন লড়তে চেয়েছিল বিজেপি। যার ফলও পেয়েছে সে রাজ্যের পদ্ম শিবির।
শিবরাজ বিজেপির একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যিনি সব থেকে বেশি সময় কুর্সিতে বসেছেন। বিজেপির অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর থেকে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকেননি।
তবে মনে করা হচ্ছে, ‘মামা’র (মধ্যপ্রদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে এই নামেই পরিচিত শিবরাজ) গদি এ বার নড়লেও নড়তে পারে।
শিবরাজের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসাবে যে নামগুলি উঠে আসছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম, গোয়ালিয়রের মহারাজ জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির ‘অভাবনীয়’ সাফল্যের নেপথ্যে জ্যোতিরাদিত্যকেই কৃতিত্ব দিতে চাইছেন কেউ কেউ।
২০২০ সালের মার্চ মাসে অনুগত বিধায়কদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের পতনের কারণ হয়েছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। সে অর্থে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম নির্বাচনী পরীক্ষা।
নতুন দলে গিয়ে জ্যোতিরাদিত্য নিজের গড় ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়েও বিজেপির অন্দরে সংশয় ছিল। তবে ভোটের ফল বলছে, রাজ্য রাজনীতিতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে সফল ‘মহারাজ’। নিজের খাসতালুক চম্বল-গোয়ালিয়রেও বিজেপিকে জিতিয়েছেন তিনি। যদিও জ্যোতিরাদিত্য প্রচারে নেমে বার বার জানিয়েছিলেন যে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নন।
কুর্সির দাবিদার হিসাবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ সিংহ পটেলও। অনগ্রসর শ্রেণির নেতা পটেলের হাত ধরে বহু ওবিসি ভোট বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ বিজয়বর্গীয় এবং কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরের নামও ভেসে বেড়াচ্ছে।
তবে সম্প্রতি নরেন্দ্র-পুত্র দেবেন্দ্র সিংহ তোমরের আর্থিক লেনদেনের বিতর্কিত ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছিল। তার জেরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি জেতার ফাইনালে গিয়ে ধাক্কা খেলেও খেতে পারেন।
প্রতিযোগিতায় রয়েছেন বিজেপির দুই ব্রাহ্মণ নেতা— রাজ্যের দলীয় প্রধান তথা সাংসদ ভিডি শর্মা এবং বিধায়ক তথা বিদায়ী রাজ্য মন্ত্রিসভার মন্ত্রী রাজেন্দ্র শুক্ল।
যদিও রাজ্য দলের একটি বড় অংশের বিশ্বাস যে, আপাতত লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেন ‘মামা’ই। আবার দলের অন্য এক অংশের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিকল্প কাউকেও বেছে নিতে পারেন।
সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির সঙ্গে কথা বলার সময় শিবরাজ বলেন, ‘‘আমরা কেউই নিজেদের নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিই না। আমরা একটি বড় লক্ষ্য নিয়ে নেমেছি। আমরা দলের কর্মী। দল যা সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই আমরা করি।’’
বিজয়বর্গীয়ের মালওয়া-নিমার অঞ্চলে ৬৬টি আসনের মধ্যে ৪৭টি বিজেপি জিতেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও তিনি পরিচিত। তাই তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ।
কিন্তু মধ্যপ্রদেশে কী ভাবে বিধানসভা ভোটের বৈতরণী পার করল বিজেপি? অতীতে প্রধানমন্ত্রী মোদী বার বার জনমুখী আর্থিক সাহায্যকে ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু ভোটের মুখে তাঁরই দলের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ ‘লাডলি বহেন’ যোজনায় মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের অঙ্ক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
কয়েকটি বুথফেরত সমীক্ষায় তার স্পষ্ট প্রভাব ধরা পড়েছিল। পুরুষদের ভোটে তুল্যমূল্য লড়লেও মহিলাদের ভোটের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপি প্রায় আট শতাংশ এগিয়ে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। তা মিলেওছে।
ভোটের আগে টাকা বিতরণ নিয়ে কংগ্রেস প্রশ্ন তুললেও তা কার্যত বুমেরাং হয়েছে। শুধু ‘লাডলি বহেন’ নয়, শিবরাজের প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল প্রতি পরিবারের কন্যাসন্তানকে দু’লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য, উজ্জ্বলা এবং লাডলি বহেন যোজনার আওতায় থাকা পরিবারকে ৪৫০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার, গরিব পরিবারকে আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন, কৃষিপণ্যে সহায়ক-মূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষক সম্মাননিধি প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে ১২ হাজার টাকা সাহায্যের কথা। মনে করা হচ্ছে তারই স্রোতে ভর করে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া অতিক্রম করেছেন ‘মামা’।
পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশে ধোপে টেকেনি কংগ্রেসের তোলা দুর্নীতি, রোজগারের অভাব, কৃষকদের ফসল না পাওয়ার মতো অভিযোগগুলিকে। রাহুল গান্ধীর জাতগণনার প্রতিশ্রুতি উচ্চবর্ণের ভোট আরও বিজেপিমুখী করেছে বলেও মনে করা হচ্ছে। তবে দলের একাংশের দাবি, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের সাফল্য বা কংগ্রেস নেতৃত্বের ব্যর্থতা নয়। মধ্যপ্রদেশে গেরুয়া শিবিরকে জয় এনে দিয়েছে ‘মোদী জাদু’।