পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের (পিওকে) উপর থেকে কি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে শাহবাজ় শরিফ সরকার? গত দু’দিন ধরে সেই প্রশ্নই আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। শুধু তা-ই নয়, পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের বিষয় নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে।
গত শুক্রবার থেকে উত্তাল পাক অধিকৃত কাশ্মীর। জম্মু-কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামি অ্যাকশন কমিটি (জেকেজেএএসি) নামে একটি স্থানীয় সংগঠনের প্রায় ৭০ জন নেতাকে গ্রেফতার করার পর থেকেই বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের একাংশ।
চড়া রাজস্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ সঙ্কটের জেরে কয়েক দিন ধরেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। গ্রেফতারির ঘটনার কারণে সেই জমা ক্ষোভ বিস্ফারিত হয়। পথে নেমে আসেন সাধারণ মানুষ। বার হয় প্রতিবাদী মিছিল। সেই মিছিল আটকাতে পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীও সক্রিয় ছিল।
পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভকারীদের আটকাতে কাঁদানে গ্যাস, ছররা থেকে বুলেটের আশ্রয় নেন নিরাপত্তারক্ষীরা। শূন্যে গুলি চালানোর পাশাপাশি জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগও উঠেছে।
সামাহনি, সেহানসা, মিরপুর, রাওয়ালকোট, খুইরাত্তা, টাট্টাপানি, হাট্টিয়ান বালা-সহ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় শনিবারও বিক্ষোভ হয়। দফায় দফায় অশান্তির জেরে একাধিক প্রতিবাদীর মৃত্যুর খবরও মিলেছে। তবে তাঁদের মৃত্যু পুলিশের গুলিতেই হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করেননি কর্তৃপক্ষ।
সূত্রের খবর, চলমান অশান্তির ঘটনায় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে এক জন পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আহত শতাধিক। তার মধ্যেই শুক্রবারে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাওয়ালকোটে উড়েছে ভারতীয় পতাকা। পাশাপাশি, ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়ে সেখানে একাধিক পোস্টারও পড়েছে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরে শান্তি ফেরাতে উদ্যোগী স্থানীয় প্রশাসন। পিওকের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক প্রতিবাদকারীদের হিংসার ঘটনা থেকে বিরত থাকার আর্জি জানিয়েছেন। তিনি জানান, আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত তাঁর সরকার।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জ়ারদারিও উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন। সমস্যা সমাধানের জন্য দ্রুত বৈঠকে বসার কথাও বলেছেন তিনি।
এই আবহেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সমাজকর্মী আমজ়াদ আয়ুব মির্জ়া আবার ভারতের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। সংবাদসংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘পিওকের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে ভারত নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। এই মুহূর্তে আমাদের লোকেরা প্রতিবাদ করছেন। পুলিশের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছেন।’’
আমজ়াদ আরও বলেন, ‘‘ভারতের উচিত এখন তাদের সমস্ত মনোযোগ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের দিকে দেওয়া। গিলগিট-বাল্টিস্তান-সহ অধিকৃত অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য আমাদের সাহায্য করা উচিত। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এখন ভারত সরকারের উচিত পিওকে নিয়ে তাদের পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া নীতি থেকে সরে এসে পদঝেপ করার। ভারত যদি এখন এগিয়ে না আসে, তবে আমরা স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণ সুযোগ হারাব।’’
পাক অধিকৃত কাশ্মীরে এই ধারাবাহিক অশান্তিতে কি আখেরে ভারতেরই লাভ? আমজ়াদের দাবির পর সেই প্রশ্নই জোরদার হচ্ছে। অনেকের মতে, পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে পাক সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের জেরে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে।
এই আবহে পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে মতামত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এক জনসভা থেকে অমিত বলেন, ‘‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ। সর্বদা সেটাই থাকবে।’’ এই বিষয়ে কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাকেও নিশানা করেছেন শাহ।
রায়বেরেলীর এক সভা থেকে শাহ বলেন, ‘‘কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার এবং ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের নেতা ফারুক আবদুল্লা বলছেন পাকিস্তানকে সম্মান করতে। কারণ তাদের কাছে পারমাণবিক বোমা আছে। আমার প্রশ্ন, কেন আমরা পাকিস্তানকে সম্মান করব?’’ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে নিশানা করে শাহ বলেন, ‘‘আপনি পারমাণবিক বোমাকে ভয় পেতে পারেন। কিন্তু আমরা ভীত নই। পিওকে ভারতেরই অংশ। আমরা সেটা ফিরিয়ে নেব।’’
২০২৩ সালে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে জম্মু ও কাশ্মীর সংরক্ষণ বিল এনেছিল কেন্দ্র। সেই বিলে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জন্যও জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় ২৪টি আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। বিল পেশের সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর আমাদেরই অংশ।’’
পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের বিরোধ বহু পুরনো। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের রাজা হরি সিংহ অনেক টালবাহানার পর ভারতের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, জম্মুর অমর প্রাসাদে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। এই চুক্তির ফলে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতীয় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীর নিয়ে সংঘাতের সূত্রপাত। জম্মু ও কাশ্মীরের দখল নিয়ে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে দু’দেশের মধ্যে অশান্তি চলছে। মাঝেমধ্যেই পিওকের নেতারা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবি জানান। তার মধ্যে পিওকেতে তৈরি হওয়া নতুন উত্তেজনা সেই দাবিই আরও জোরালো করল বলে মত অনেকের।